‘৪২ লাখ টাকা নিয়া আমার ভাইরে গুলি কইরা মাইরা ফালাইছে তারা’
বাংলাদেশ

‘৪২ লাখ টাকা নিয়া আমার ভাইরে গুলি কইরা মাইরা ফালাইছে তারা’

‘আমাদের আর দেখার মতো কেউ রইলো না। বাবা-মায়ের সংসার চালানোরও কেউ নাই। আমার দুই ভাই ছিল। দুইটা ভাই-ই মইরা গেলো। এখন আমার মা-বাবা কীভাবে বাঁচবে? এলাকার দালাল শিপন খান আমাদের চাপ দিয়া, ভয় দেখাইয়া টাকা নিছে। বাবার যত জমিজমা ছিল সব বিক্রি করে শিপনকে প্রথমে ২২ লাখ, পরে আরও ২০ লাখ টাকা দিছে। তবু ওরা আমার ভাইডারে ভালোভাবে ইতালি নিয়ে গেলো না। পথেই গুলি কইরা মাইরা ফালাইলো। আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো।’

এভাবেই কথাগুলো বলেছেন মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের ইমরান খানের (২৫) বোন ফাতেমা বেগম। মাদারীপুর সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করার পরও ভালো চাকরি হচ্ছিল না ইমরানের। স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইতালি গিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরি করবেন। তবে অবৈধভাবে সেখানে যাওয়ার পথে প্রাণ হারান। পরিবারের বড় ছেলে কয়েক বছর আগে মারা যাওয়ায় তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, গত মঙ্গলবার তারা এক দালালের মাধ্যমে জেনেছেন, ১ নভেম্বর লিবিয়ার উপকূলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নৌকায় জলদস্যুদের গুলিতে নিহত হন ইমরান। পরে তার লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবেই অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকায় গুলি করলে প্রাণ হারান জেলার আরও দুই যুবক মুন্না তালুকদার আর বায়েজিদ শেখ। তাদের মৃত্যুতে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তাদের বিদেশে পাঠানোর ঘটনায় জড়িত দালালদের শাস্তি দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।

তৈয়ব আলী ও রেহেনা বেগম দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে রায়হান খান সাত বছর আগে মারা গেছেন। ছোট ছেলে ইমরান খান ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ইমরানের বোন বলেন, ‌‘পরিবারকে ভালো রাখতে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার জন্য গত ৮ অক্টোবর বাড়ি ছেড়েছিল ইমরান। সরাসরি ইতালি পৌঁছে দেবে এমন শর্তে প্রতিবেশী ও মানবপাচার চক্রের সদস্য শিপন খানের সঙ্গে চুক্তি হয় ২২ লাখ টাকায়। কিন্তু ইমরানকে লিবিয়া আটকে নির্যাতন করে পরিবার থেকে আরও ২০ লাখ টাকা আদায় করা হয়। শেষে ১ নভেম্বর লিবিয়া থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে ভূমধ্যসাগরে মাফিয়ার গুলিতে মারা যায় ইমরান। মঙ্গলবার তার মৃত্যুর খবর পাই আমরা।’

শুধু ইমরান নন, একইভাবে গুলিতে ওই দিন মারা যান রাজৈর উপজেলার দুর্গাবদ্দী গ্রামের ইমারাত তালুকদারের ছেলে মুন্না তালুকদার, একই উপজেলার ঘোষলাকান্দি গ্রামের কুদ্দুস শেখের ছেলে বায়েজিদ শেখ। তিন যুবকের মৃত্যুর পর লাশ ফেলে দেওয়া হয় সাগরে। এমন মুত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। ঘটনা জানাজানি হলে ঘরে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা দালাল চক্রের পরিবারের লোকজন। 

মুন্না তালুকদারের স্বজনদের আহাজারি

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শিপন খানের বাড়ি একই এলাকায়। তিনি ১০ বছর ধরে লিবিয়াপ্রবাসী। নিজ এলাকা ছাড়াও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেককেই অবৈধপথে ইতালি পাঠান শিপন। তাদের দাবি, এক বছরে আদিত্যপুর এলাকা থেকে ৫০ জনের বেশি যুবককে ইতালি পাঠিয়েছেন। তার এ কাজে সরাসরি সহযোগিতা করেন ভাই সেলিম খান। তিন যুবকের মৃত্যুর পর ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন তারা।

অভিযোগ আছে, কয়েক বছর ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন শিপন। আত্মীয়-স্বজনরদের মাধ্যমে এলাকার যুবকদের ইতালি নেওয়ার কথা বলে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন। বারবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন শিপন।

ইমরানের বোন ফাতেমা বেগম বলেন, ‘শিপন আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। তার কঠিন বিচার চাই। সরকারের কাছে দাবি, আমার ভাইয়ের লাশ যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করে।’

ইমরানের স্বজন সাজ্জাদ মাতুব্বর বলেন, ‘দালাল শিপনের হাত অনেক লম্বা। এর আগেও একইভাবে কয়েকজন যুবকের মৃত্যু হয়েছিল। টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলে। শিপনের কোনও বিচার না হওয়ায় এ অপরাধ থামছে না। আমরা দালাল শিপন ও তার সহযোগীদের কঠিন বিচার দাবি করছি।’

নিহত মুন্নার খালা খাদিজা আক্তার বলেন, ‘দালাল শিপনকে ধারদেনা করে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি। আমার ভাগনের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এই দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। পাশাপাশি মুন্নার লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে আকুতি জানাচ্ছি।’

 এমন মুত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা

বায়েজিদের বাবা কুদ্দুস শেখ বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুতে আমার পরিবার শেষ। দালাল শিপন প্রথমে স্বীকার করেনি। পরে লিবিয়া থেকে মৃত্যুর খবর জানানো হয়। এরপর থেকে দালাল লাপাত্তা। এতগুলো টাকা দিয়ে ছেলের এমন মৃত্যুর শোক কীভাবে সইবো।’

শিপনের চাচি সেতারা বেগম বলেন, ‘শিপন অনেক মানুষকে ইতালি নিয়েছে। কিন্তু গুলিতে কেউ মারা গেছে এমন ঘটনা আমরা এর আগে কখনও শুনি নাই। শিপন লিবিয়ায় অবস্থান করছে। তার পরিবারের লোকজন এখন বাড়িতে নেই। ঘরে তালু ঝুলছে। আমরা এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।’

এ ব্যাপারে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘লিবিয়ায় গুলিতে তিন যুবকের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছি। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবার থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। দালালদের ছাড় দেওয়া হবে না।’

Source link

Related posts

প্রথম পর্বের মুসল্লিরা মাঠ বুঝিয়ে দেওয়ার পর দ্বিতীয় পক্ষকে ডাকা হবে: আইজিপি

News Desk

নারায়ণগঞ্জে পত্রিকা অফিসে হামলা: ৮ আসামির জামিন নামঞ্জুর

News Desk

মিরসরাইয়ে বাক প্রতিবন্ধী কিশোরী ধর্ষিত

News Desk

Leave a Comment