সাতক্ষীরায় ঘরে ঘরে চর্মরোগ, চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত সেবা
বাংলাদেশ

সাতক্ষীরায় ঘরে ঘরে চর্মরোগ, চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত সেবা

সাতক্ষীরা জেলাজুড়ে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ। চুলকানি, দাদ, একজিমাসহ নানা সংক্রামক ত্বকের সমস্যায় ভুগছেন হাজারো মানুষ। এর মধ্যে নারী ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত। তবে জেলার প্রধান দুটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ কোনও চিকিৎসক না থাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একদিকে রোগের যন্ত্রণা, অন্যদিকে চিকিৎসা না পাওয়ায় মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় লোকজন। তবে জেলায় ঠিক কত মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত, সে তথ্য নেই সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। এমনকি কোনও ধরনের জরিপও করা হয়নি। 

আক্রান্ত লোকজন বলছেন, জেলায় কমবেশি প্রায় সব পরিবারে চর্মরোগে আক্রান্ত রোগী আছে। এমন কোনও পরিবার নেই যার কোনও সদস্য আক্রান্ত হননি। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন চর্মরোগের মধ্যে হাতের একজিমা অন্যতম। নারীরা বিশেষ করে যারা পানির কাজ করেন বেশি, সারা দিন সাবান বা সোডাজাতীয় জিনিসের সংস্পর্শে আসেন, কাপড়চোপড় বা বাসনকোসন পরিষ্কার করেন, তারা সাধারণত আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। চর্মরোগ হলে শুরুতে আঙুলগুলো লাল ও শুকনা হয়ে ফেটে যায়। হাতের চামড়ায় ফোসকা পড়ে। অনেক সময় ত্বক ফেটে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। 

এ অবস্থায় সংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ না দিলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জেলার সচেতন মহল।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাতক্ষীরায় চর্মরোগের এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস এবং দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে লোকালয়ে প্রায়ই লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে। দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ত পানির ব্যবহারের ফলে মানুষের ত্বকের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে স্ক্যাবিস, দাদ, একজিমার মতো ছোঁয়াচে রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।

চিকিৎসার জন্য হাহাকার

সাতক্ষীরা সদরের ফয়জুল্যাপুর গ্রামের গৃহবধূ ফিরোজা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত তিন বছর ধরে সারা শরীরে চুলকানি আর পাঁচড়া। ডাক্তাররা পুকুরের পানিতে গোসল করতে নিষেধ করেছেন। কিছু ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু কোনও কাজ হচ্ছে না। উল্টো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। এরপর সরকারি হাসপাতালে গিয়েও ঠিকমতো কোনও ধরনের চিকিৎসা পাইনি। আর টাকার অভাবে বারবার ডাক্তারের কাছেও যেতে পারছি না।’

সদরের চেয়ে উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে এই রোগী বেশি। এর মধ্যে শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ অন্যতম। লবণাক্ত পানি এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বাসিন্দা নমিতা রানী বলেন, ‘প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়ে। এই পানি ব্যবহারের ফলে আমাদের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে চুলকানি হয়, ঘা-পাঁচড়া তো আছেই। সেইসঙ্গে নারীদের বিভিন্ন ধরনের গোপন রোগও বাড়ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই চুলকানিতে ভুগছি। চুলকাতে চুলকাতে চামড়া উঠে ঘা হয়ে গেছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুদের সমস্যা বেশি। লজ্জায় তারা এই রোগ কাউকে দেখাতে পারে না, ফলে সঠিক চিকিৎসাও নিতে পারছে না। এজন্য একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়। অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।’

চিকিৎসা না পাওয়ার কথা জানিয়ে সাতক্ষীরা পৌরসভার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে ৫-১০ টাকায় ডাক্তার দেখানো যেতো। এখন ডাক্তার না থাকায় বেসরকারি চেম্বারে ভিজিট লাগে ৫০০-৬০০ টাকা। তার ওপর হাজার টাকার ওষুধ। আমরা গরিব মানুষ। এত টাকা পাবো কোথায়। টাকার অভাবে অনেকে চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে পারছে না। সরকারি হাসপাতালে গেলে বলা হয়, চিকিৎসক নেই।’

বাড়ছে ঝুঁকি 

সাতক্ষীরা জেলা জলবায়ু পরিষদের সদস্যসচিব ও পরিবেশবিদ অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলে পানির তীব্র সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পানি জমে থেকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এই জমে থাকা দূষিত পানির কারণে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অন্য কোনও উপায় না থাকায় মানুষ দূষিত পানিই দৈনন্দিন কাজে, এমনকি পান করার জন্যও ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ এই পানি পান করে। খুব কম সংখ্যক মানুষ টাকা দিয়ে পানি কিনে পান করতে পারে। এই পানি স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় শরীরে খারাপ প্রভাব পড়ে ঝুঁকি বাড়ছে। যা সামনে আরও বাড়বে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে গেছে জানিয়ে এই পরিবেশবিদ আরও বলেন, ‘বাতাস এবং পারিপার্শ্বিক লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের শরীর, বিশেষ করে ত্বক, এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। অতিরিক্ত গরম এবং মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে মানুষের গায়ে র‍্যাশ, ঘা এবং বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে, যা আগে ছিল না। আগে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ভালো ছিল এবং তারা প্রোটিনযুক্ত খাবার পেতো। যার ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মানুষ আগের মতো পুষ্টিকর খাবার, বিশেষ করে প্রোটিন পাচ্ছে না। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে রোগের প্রবণতা আরও বাড়ছে।’

নারীরা বিশেষ করে যারা পানির কাজ করেন বেশি, সারা দিন সাবান বা সোডাজাতীয় জিনিসের সংস্পর্শে আসেন; তারা আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন

চিকিৎসক সংকট

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ একজন মাত্র চিকিৎসক আছেন। তাও তিনি প্রতিদিন রোগী দেখেন না। পাশাপাশি সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি মাত্র পদ রয়েছে। সেটিও এক বছর ধরে শূন্য। ফলে জেলায় দিন দিন রোগী বাড়লেও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে রোগটি অন্যদের মাঝে ছড়াচ্ছে।

সরকারি হাসপাতালে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন আব্দুস সালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সদর হাসপাতালে একজন চিকিৎসক আছেন, তিনি সপ্তাহে তিন দিন রোগী দেখেন। তার মূল কর্মস্থল কালিগঞ্জ উপজেলায়। এ ছাড়া আর কোনও চিকিৎসক নেই। চিকিৎসক সংককের বিষয়টি জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. কুদরত-ই-খোদা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভৌগোলিকভাবে নিচু এই অঞ্চলে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস এবং ভঙ্গুর বেড়িবাঁধের কারণে প্রায়ই লোকালয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে। দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা এবং লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে আসার ফলে মানুষের ত্বকের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর ফলে স্ক্যাবিস, দাদ, একজিমার মতো রোগগুলো সহজে ছড়িয়ে পড়ছে। যা মহামারির আকার ধারণ করার পথে। মেডিক্যাল কলেজ চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি মাত্র পদ এক বছর ধরে শূন্য আছে। ডা. মুসাদ্দিক হোসাইন খানকে কালিগঞ্জে বদলি করার পর আর কেউ আসেননি এখানে। আমরা একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েও কোনও সাড়া পাইনি।’

নাগরিক সমাজের দাবি

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আজাদ হোসেন বেলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই জেলায় লবণাক্ত পানির কারণে চর্মরোগ বাড়ছে। অথচ প্রধান হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার নেই। এটা দুঃখজনক। আমাদের দাবি, অবিলম্বে সদর হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হোক।’

চর্মরোগ পরিবারের একজনের হলে অন্যদেরও হয়, সচেতনতার অভাব

এই রোগের ব্যাপকতা বাড়ার কারণ হিসেবে চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মুসাদ্দিক হোসাইন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি স্ক্যাবিস বা দাদের মতো ছোঁয়াচে রোগ। পরিবারের একজনের হলে অন্যদেরও হয়। অনেকে লজ্জায় বা অবহেলায় শুরুতে চিকিৎসা করান না। এটি সচেতনতার অভাব। ফার্মেসি থেকে মলম কিনে ব্যবহার করায় রোগের তীব্রতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন করোনার টিকার কারণে হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ গুজব। এটি ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় পরিবারের আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা রাখা, তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র আলাদাভাবে পরিষ্কার করা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সতর্ক থাকতে হবে।’

উপায় না থাকায় মানুষ দূষিত পানিই দৈনন্দিন কাজে, এমনকি পান করার জন্যও ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে

চর্মরোগ এড়া‌তে যেসব প‌রামর্শ দি‌চ্ছেন চি‌কিৎসকরা

ক) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: প্রতিদিন পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করা জরুরি। শরীর, বিশেষ করে ভাঁজের জায়গাগুলো (যেমন- কুঁচকি, বগল, আঙুলের ফাঁকা জায়গা) গোসলের পর ভালোভাবে মুছে শুকনো রাখতে হবে। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে ত্বকে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া সহজে জন্মায়।

খ) গরমকালে সুতির এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরা। খুব আঁটোসাঁটো পোশাক এড়িয়ে চলা। কারণ এতে ঘাম জমে ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকখানি বাড়ে। ঘামে ভেজা পোশাক বেশিক্ষণ পরে থাকবেন না।

গ) অন্যের ব্যবহার করা তোয়ালে, চিরুনি, জামাকাপড় বা সাবান ব্যবহার করবেন না। এই জিনিসগুলোর মাধ্যমে সহজেই ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যা থেকে দাদ বা খোসপাঁচড়ার মতো রোগ হয়।

ঘ) অতিরিক্ত রোদ ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। বাইরে বের হওয়ার অন্তত ২০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। এটি ত্বককে রোদে পোড়া, অ্যালার্জি এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি থেকে বাঁচায়।

ঙ) প্রচুর পরিমাণ পানি পান করলে ত্বক ভেতর থেকে আর্দ্র ও সতেজ থাকে। পাশাপাশি, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ ফল এবং শাকসবজি খেলে ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং ত্বক সুস্থ থাকে।

Source link

Related posts

মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে ৩ গ্রাম প্লাবিত

News Desk

তিন দিনের রিমান্ডে হেলেনা জাহাঙ্গীর

News Desk

রাজশাহী মেডিকেলে করোনায় আরও ১১ জনের মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment