সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই নেই, তবু নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা
বাংলাদেশ

সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই নেই, তবু নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে ৭৩টি সংস্থার প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। তাতে দিনাজপুরের তিনটি সংস্থা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটির কার্যালয় ও কার্যক্রম আছে। একটির নিজস্ব কোনও কার্যালয় এমনকি কার্যক্রম নেই। নাম সচেতন নাগরিক সোসাইটি। বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখলেও কোনও সরঞ্জামাদি নেই। বলা চলে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান এটি।

সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই নেই সচেতন নাগরিক সোসাইটির

দিনাজপুর শহরের ৬ নম্বর উপশহর (পুরাতন) ব্লকের এ/১১ নম্বর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সচেতন নাগরিক সোসাইটি নামে একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। মূলত এটি বসতবাড়ি। দোতলা এই বাড়ির নিচতলায় সাইনবোর্ড টানানো দেখে ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় ফাঁকা একটি কক্ষ। যেটিকে সংস্থার কার্যালয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কক্ষটিতে চেয়ার-টেবিল কিংবা আসবাবপত্র কিছুই নেই।

সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক এমএসএইচ বাধন চৌধুরী জানান, ২০১৩ সালে সংস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালে নিবন্ধিত হয়। সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব সদর উদ্দিন আহমেদ। তার ভাই সালেহ উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে লালমনিরহাট-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালের ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে লালমনিরহাট-২ আসন থেকে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। 

সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আবু তালেব। ২০১৬ সালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। নির্বাহী পরিচালক হিসেবে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য শামীম আজাদ চৌধুরী, পরিচালক হিসেবে রয়েছেন যথাক্রমে এমএসএইচ বাধন চৌধুরী ও তার চাচাতো ভাই ঢাকা জজ আদালতের আইনজীবী আরেফিন তুষার।

এমএসএইচ বাধন চৌধুরী আরও জানান, একসময় এই সংস্থার মাধ্যমে সাঁতার শেখানো হতো, পথশিশুদের শিক্ষা দেওয়া হতো ও নারী উদ্যোক্তা তৈরির কার্যক্রম চলতো। এ ছাড়া নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ, ব্লক, বটিক প্রশিক্ষণ ও দুস্থদের জন্য মেডিক্যাল ক্যাম্প করা হতো। কিন্তু ফান্ড সংকটের কারণে বর্তমানে এসব কার্যক্রম বন্ধ আছে। নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করতে ফান্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সংস্থায় নেই কোনও কর্মী

সংস্থায় কতজন কর্মী আছেন জানতে চাইলে বাধন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘এখানে কাগজে-কলমে ছয় হাজার ৬২০ জন স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। প্রতিটি উপজেলায় স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। এখানে যারা কাজ করেন সবাই স্বেচ্ছাসেবী। বেতনভুক্ত কোনও কর্মী নেই। যেহেতু কার্যক্রম নেই, তাই কর্মীও নেই।’

কেন নির্বাচনের পর্যবেক্ষক হতে আবেদন?

এমএসএইচ বাধন চৌধুরী বলেন, ‌‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার আগ্রহ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাস্তবায়নে অবদান রাখতে এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে আবেদন করা হয়েছিল। পরে জানতে পেরেছি, নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক তালিকায় আমরা আছি।’

একই বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য শামীম আজাদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছি। এবার প্রথম নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে আবেদন করা হয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাস্তবায়ন করতে আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করবেন। এটি পুরোপুরি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ফান্ড ক্রাইসিসের জন্য বর্তমানে কার্যক্রম বন্ধ আছে।’ 

ব্যতিক্রম পল্লীশ্রী সংস্থা

ভোট পর্যবেক্ষণে ইসির তালিকায় থাকা আরেক প্রতিষ্ঠানের নাম পল্লীশ্রী। শহরের বালুবাড়ি এলাকার ৩ নম্বর রোডের ৬০৬ নম্বর নিজস্ব ভবনে চলছে এর কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। নারী অধিকার, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছে সংস্থাটি। এটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবে রয়েছেন তসলিমা বেগম। ভাইস চেয়ারপারসন হিসেবে আছেন অধ্যাপক খুরশীদা বেগম। সাধারণ সম্পাদক জ্যোৎস্না বেগম। কোষাধ্যক্ষ সুবাস পিটার থিওটোনিয়াস। নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে রয়েছেন উম্মে কুলসুম, নাসিমা বেগম রেবা, লক্ষ্মী কান্ত রায় এবং নির্বাহী পরিচালক হিসেবে আছেন শামিম আরা বেগম। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে চলা এই সংস্থার বেশ নাম-ডাক রয়েছে জেলায়। যারা এখানে রয়েছেন তারা রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নন। দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে। নারীদের পারিবারিক সমস্যা সমাধান, মামলা সংক্রান্ত জটিলতা, বৈঠক, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার নিয়ে কাজ করছে। এখানে কর্মরত আছেন ২৭৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

সংস্থার চেয়ারপারসন তসলিমা বেগমের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। সংস্থার এইচআর ইনচার্জ শামীমা পপি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন চাওয়ার পর থেকে আমাদের কাছে অনেকে এসেছিলেন। অনেক কাগজপত্র ও বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। আমরা এর আগেও নির্বাচন ও ভোটাধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের কেউ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। মানুষের অধিকার, নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছি আমরা।’

দিনাজপুর পল্লী উন্নয়ন প্রচেষ্টা (ডিপিইউপি)

নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইসির তালিকায় থাকা আরেক সংস্থার নাম দিনাজপুর পল্লী উন্নয়ন প্রচেষ্টা। ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে এটি। শহরের রাজবাটীতে নিজস্ব ভবনে পরিচালিত সংস্থাটিতে জনবল রয়েছেন ৫২ জন। এ ছাড়া এটির আওতায় দক্ষ জনশক্তি গড়ার প্রকল্পে কাজ করছেন আরও ৭২ জন কর্মী।

স্থানীয় লোকজন ও সংস্থার দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুস্থ ও অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী করতে বিনামূল্যে ছাগল বিতরণ কার্যক্রম, কর্মসংস্থান সৃষ্টির কার্যক্রম, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, কম্পিউটার অপারেশন, সেলাই প্রশিক্ষণ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রশিক্ষণ, কৃষকদের কৃষি ঋণ প্রদান, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ কার্যক্রম ও গৃহায়ণ তহবিল দেওয়ার কাজ করছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক, এনজিও ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। এ ছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, মানবপাচার প্রতিরোধ, আর্সেনিক নির্ণয়, দুস্থ নারীদের প্রশিক্ষণ, অসহায় মানুষের জন্য মেডিক্যাল ক্যাম্প, কৃষকদের সোলার প্যানেল প্রদান, শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানা সামাজিক কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। এটি ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৭ সালে সমাজসেবা অধিদফতর ও যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে নিবন্ধিত হয়। ২০১৩ সালে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো ও ২০১৭ সালে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি কর্তৃক নিবন্ধিত হয় সংস্থাটি।

শহরের রাজবাটীতে নিজস্ব ভবনে পরিচালিত সংস্থাটিতে জনবল রয়েছেন ৫২ জন

সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন খোরশেদ আলম, ভাইস চেয়ারম্যান মিথন চন্দ্র সরকার, সদস্যসচিব ও নির্বাহী পরিচালক হিসেবে আছেন রনজিৎ কুমার সরকার, অর্থ সচিব সুচিত্রা বসাক এবং নির্বাহী সদস্য হিসেবে রয়েছেন যথাক্রমে শরিফুল ইসলাম, রত্না রানী দাস ও অর্চনা সরকার।

নির্বাহী পরিচালক রনজিৎ কুমার সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে নানা সামাজিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরা এর আগেও নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে কাজ করেছি। মানুষ যেন তাদের ভোটাধিকার সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে প্রয়োগ করতে পারে, সেজন্য পর্যবেক্ষক সংস্থা হতে চাচ্ছি।’

ইসির গণবিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, গত ২৭ জুলাই তারা পর্যবেক্ষক নিবন্ধনের জন্য আবেদন চেয়েছিল। তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল। যাচাই-বাছাই করে ৭৩টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছে ইসি।

কমিশনের শর্ত কী কী

নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পর্যবেক্ষক নীতিমালায় বলা হয়েছে, গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করছে এবং নিবন্ধিত গঠনতন্ত্রের মধ্যে এ বিষয়সহ সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে তথ্য প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণের অঙ্গীকার রয়েছে, কেবল সেসব বেসরকারি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বা আছেন—এমন কেউ পর্যবেক্ষণের জন্য আবেদনকারী কোনও সংস্থার প্রধান নির্বাহী কিংবা পরিচালনা পর্ষদে থাকলে ওই সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হবে না।

Source link

Related posts

এটা হবে কঠোর লকডাউন, ৭ দিন যেখানে আছেন, সেখনেই থাকবেন

News Desk

জলাবদ্ধতায় চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে

News Desk

বিশুদ্ধ পানির সংকট বরিশাল নগরীতে, ঘরে ঘরে হাহাকার

News Desk

Leave a Comment