শাড়ির বুননে সন্তানদের স্বপ্ন আঁকেন মায়েরা
বাংলাদেশ

শাড়ির বুননে সন্তানদের স্বপ্ন আঁকেন মায়েরা

অভাবের সংসারে সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে তাঁতের কাজ শুরু করেছেন জুঁই আক্তার। বাড়িতে নিজের কেনা তাঁতের মেশিনে নিয়মিত শাড়ি বুনছেন। একইসঙ্গে আঁকছেন সন্তানদের স্বপ্ন। আশা করছেন, স্বাবলম্বী হওয়ার এবং বাল্যবিবাহ রোধ করে মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার।  

জুঁই আক্তারের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ইউনিয়নের চর শৌলমারী গ্রামে। ওই গ্রামের দিনমজুর সিরাজুলের স্ত্রী তিনি। এই দম্পতির দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে একাদশ শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ সংসারে সামাজিক বাস্তবতায় বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে তাদের দুই মেয়ে। তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও রোজগার শুরু করেছেন এই নারী। এতে করে বাল্যবিয়ে থেকে মুক্তি মিলেছে দুই কিশোরীর।

জুঁই আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এহনে মেয়ে বিয়া দিমু না। বিয়া দিমু ক্যা? এই যে শ্রম দিতাছি কার জন্যে? ওদের জন্যে (মেয়েদের) তো শ্রম দিতাছি। পড়াশোনা শিখায় উপযুক্ত বয়সে বিয়া দিমু।’

চরশৌলমারী গ্রামের চর শৌলমারী ডিগ্রি কলেজের ঠিক উত্তরে বসবাস গৃহবধূ চায়না বেগমের। তার সম্বল পাঠখড়িতে নির্মিত একটি মাত্র ঘর। ওই ঘরে তিন মেয়ে নিয়ে বসবাস। স্বামী মোহাম্মদ আলী ইটভাটা শ্রমিক। টানাপোড়নের সংসারে টিকে থাকতে ঘরের আঙিনায় পেঁপেসহ সবজি আর বস্তায় আদা চাষ করেছেন।
চায়নার ছোট মেয়ে কোলের শিশু। বড় মেয়ে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে আর মেজো মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। অভাবের সংসারে এ দম্পতি মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেননি। তাদের সঙ্গে নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছেন। বাড়তি আয়ের জন্য তাঁতের শাড়ি বুনছেন চায়না। নিজের ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় শাশুড়ির ঘরের এক কোণে মেশিন বসিয়ে তৈরি করছেন তাঁতের শাড়ি। সেই শাড়ি বিক্রির টাকায় চলছে মেয়েদের লেখাপড়া।

চায়না বেগম বলেন, ‘স্বামীর রোজগারে সংসার আর মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটান যায় না। আরডিআরএস থেকে তাঁত চালানোর প্রশিক্ষণ নিছি। তারা মেশিন কেনার টাকাও দিছে। পুরান মেশিন কিনছি। পাশের বাড়ি থেকে শাড়ির নকশা তোলা শিখছি। অহন বড় মেয়েরে সাথে নিয়া প্রতি দুই দিনে একটা কইরা শাড়ি তৈরি করি। মহাজন সুতা দেয়। আমরা শাড়ি তৈরি করে দিই। প্রতি শাড়ির জন্য ৬৫০ টাকা পাই। মাসে ১৮-২০টা শাড়ি তৈরি করতে পারি। সংসারের কাজের সাথে তাঁতের কাজ করে যে আয় করতাছি, তাতে দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাইতে পারছি। ওরা যদ্দিন ইচ্ছা পড়বো, তারপর বিয়াশাদি।’

চর শৌলমারী গ্রামে তাঁতশিল্প অনেক পরিবারে বাড়তি আয়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সংসারের কাজের পাশাপাশি তাঁত প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। বাড়তি আয় করছেন। চায়না ও জুঁইয়ের মতো ওই ইউনিয়নের ৫০টি পরিবাররের নারীদের তাঁত প্রশিক্ষণ দিয়েছে আরডিআরএস বাংলাদেশ। সংস্থাটির চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের আওতায় তারা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাঁত মেশিন কেনার আর্থিক অনুদান পেয়েছেন। সেই টাকায় মেশিন কিনে নিজেরা শাড়ি তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন। সেই আয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। ফলে বাল্যবিয়ের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাচ্ছে কিশোরীরা।

সিএনবি প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, চর শৌলমারী গ্রামে গত এক বছরে ৬০ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। যাদের সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এখনও বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত ১৮০টি পরিবার। এমন পরিবারের ৫০ জন নারীকে প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণের পর তাঁত মেশিন কেনার আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। এতে পরিবারগুলো বাড়তি আয়ের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বিয়ের ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে।

সিএনবি প্রকল্পের কুড়িগ্রাম জেলার সমন্বয়কারী অলিক রাংসা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এনআরকে-টেলিনথ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে। বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এই প্রকল্পের একটি অংশ। যাতে পরিবারগুলো মেয়েদের বোঝা মনে না করে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারে। এতে জেলায় বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের হার পূর্বের তুলনায় কমে আসছে।’

Source link

Related posts

টানা বর্ষণে প্লাবিত বান্দরবানের নিম্নাঞ্চল, দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি

News Desk

আলুক্ষেত নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা

News Desk

টিলা ধসে একসঙ্গে ৩ শিশুর মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment