যে রেলপথে ট্রেন চলে বাইসাইকেলের গতিতে
বাংলাদেশ

যে রেলপথে ট্রেন চলে বাইসাইকেলের গতিতে

রেললাইনে নেই পাথর। অর্ধপচা কাঠের স্লিপার দেবে আছে মাটির ভেতর। কোথাও কোথাও লাইনের মাঝে ঘাস। দুই লাইনের সংযোগস্থলে চারটির স্থলে দুটি করে নাট-বল্টু। এমন রেলপথে বাইসাইকেলের গতিতে চলছে ট্রেন। সবচেয়ে ধীরগতির ট্রেনটিতে ভ্রমণ করতে চাইলে স্টেশনে অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। যাত্রাপথের কোনও একটি স্থানে রেলপথের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেই ট্রেনে ওঠা যায়।

কুড়িগ্রামের উলিপুরের পাঁচপীর রেলস্টেশন থেকে চিলমারীর রমনা রেলস্টেশন পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেলপথে ঘণ্টায় মাত্র ১৫ কিলোমিটার গতিতে চলে ‘রমনা লোকাল ট্রেন’। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে এক ঘণ্টার বেশি। অথচ এক ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটারের বেশি পথ বাইসাইকেল চালিয়ে যাওয়া যায়।

গত ১৭ আগস্ট কুড়িগ্রাম-চিলমারী রেলপথে একদিনে দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছিল। ওই দিন দুপুর ১২টার দিকে ‘রমনা লোকাল’ ট্রেন উলিপুর উপজেলার তবকপুর ইউনিয়নের রসুলপুর এলাকায় চিলমারীর বালাবাড়ী রেলস্টেশনের উত্তরে লাইনচ্যুত হয়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে লালমনিরহাট থেকে ওই ট্রেন উদ্ধারে আসা উদ্ধারকারী ট্রেনটিও উলিপুরের পাঁচপীর রেলস্টেশন পার হওয়ার পর লাইনচ্যুত হয়।

ট্রেনের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি দেশের সবচেয়ে ধীরগতির রেলপথ। এই পথে দেশের সবচেয়ে ধীরগতিতে ট্রেন চলে; এই গতিও ট্রেন চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দীর্ঘ রেলপথের লাইনে কোনও পাথর নেই। বেশিরভাগ স্থানে স্লিপার অর্ধপচা। তাও সেগুলো মাটির নিচে দেবে আছে। কোথাও কোথাও স্লিপারের নিচের মাটিও সরে গেছে। মধ্যবর্তী স্থানে মাটি আর ঘাস। পাথরের পরিবর্তে পুরো রেলপথ মাটির ওপর দিয়ে বিছানো। এমন অবস্থা নিয়ে নিয়মিত চলছে ট্রেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঁচপীর স্টেশন থেকে রমনা স্টেশন পর্যন্ত রেলপথে পাথর নেই। পুরো পথটি ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি বিবেচনায় এই রেলপথে ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই গতি নিয়েও ট্রেন চলতে পারে না। চলার সময় দুই দিকে দোলে। কোনও কোনও দিন লাইনচ্যুত হয়।

বাইসাইকেলের গতিতে চলার কারণে পাঁচপীর থেকে চিলমারীর রমনা যেতে রেলপথের যেকোনও স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলেই ট্রেনে ওঠা সম্ভব। বাস্তবে ঘটছেও তাই। রেলপথের যেকোনও স্থান থেকে শিশু-কিশোররা ইচ্ছেমতো চলন্ত ট্রেনে উঠে আবার নেমে যাচ্ছে। কেউ কেউ ট্রেনের এমন গতিকে উপহাস করতে চলন্ত ট্রেনের এক বগি থেকে নেমে আরেক বগিতে উঠছে। যেন খেলনা ট্রেন।

লালমনিরহাট রেল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাঁচপীর স্টেশন থেকে রমনা পর্যন্ত রেলপথের সংস্কারের জন্য এক বছরেরও বেশি সময় আগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিশ্বাস কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুধু মাটি ভরাট আর কয়েকটি রেলসেতু মেরামত করলেও রেললাইন, স্লিপার পরিবর্তন এবং পাথর ফেলার কাজ হয়নি। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারকাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে রেলপথটি ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে।

রমনা লোকাল ট্রেনের একাধিক পরিচালকের (গার্ড) সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এই রেলপথে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালাতে হয়। লাইনের এতটাই দুরবস্থা যে নির্ধারিত ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার গতিতেও চালানো যায় না। কবে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে, তা রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।

ট্রেনটির পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লাইনের সমস্যা। স্লিপার নেই, পাথর নেই। কুড়িগ্রাম থেকে রমনা পর্যন্ত ঘণ্টায় ১৫-২০ কিলোমিটার গতিতে চালাতে বলা হয়। এজন্য সময় বেশি লাগে।’

এ বিষয়ে তিস্তা থেকে চিলমারী পর্যন্ত রেলপথের দায়িত্বে থাকা লালমনিরহাট রেল বিভাগের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পিডব্লিউআই) বজলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক বছর আগে প্রায় ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলপথ সংস্কারকাজ শুরু হয়েছিল। মাটি ভরাট ও সেতুর কাজ হলেও লাইন, পাথর ও স্লিপারের কাজ হয়নি। স্লিপার সংকটের কারণে বর্তমানে কাজ বন্ধ আছে। রেলপথটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের এক কর্মচারী বলেন, ‘রেলপথটি ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু আবেগে এই পথে ট্রেন চালানো হচ্ছে। জরুরি সংস্কার ছাড়া এভাবে ট্রেন চলতে থাকলে যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’

রেলপথটির সংস্কারকাজের বিষয়ে জানতে চাইলে লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক আবু হেনা মোস্তফা আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পথটি আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ। স্লিপার সংকট ও রেললাইন পরিহন সমস্যার কারণে সংস্কারকাজ বন্ধ রয়েছে। আগামী অক্টোবর কিংবা নভেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু হতে পারে।’

Source link

Related posts

খুলনার তিন হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ১১ জনের মৃত্যু

News Desk

ধীরে নামছে পানি, ভোগান্তি চরমে

News Desk

আগাম আলু চাষ করে বিঘায় লাভ ৫০-৬০ হাজার টাকা

News Desk

Leave a Comment