প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থায়নে কেনা দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ হাতে পাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। চীনে তৈরি হওয়া জাহাজ দুটি সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি হেলনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস। এরই মধ্যে বিএসসির বহরে যুক্ত হয়েছে একটি। এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘এমভি বাংলার প্রগতি’। অপরটি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বহরে যুক্ত হওয়ার কথা আছে।
গত ২৩ অক্টোবর চীনা শিপইয়ার্ড জিংজিয়াং নানিয়াং শিপবিল্ডিং কোম্পানি থেকে জাহাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে বিএসসি। এটি বিএসসির বহরে যুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয়টি। আর ‘এমবি বাংলার নবযাত্রা’ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বহরে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। জাহাজ দুটি কিনতে ব্যয় হচ্ছে ৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯৮ হাজার ডলার, যা ৯৩৫ কোটি টাকার মতো। জাহাজ দুটি থেকে বছরে ২০০ কোটি টাকা আয় হবে বলে আশা করছে বিএসইসি।
বিএসসি সূত্রে জানা যায়, গত ২১ সেপ্টেম্বর বিএসসি ও হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসির মধ্যে দুটি আধুনিক বাল্ক ক্যারিয়ার সংগ্রহে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আগে ১২ আগস্ট সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় জাহাজ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন পায়। প্রতিটি জাহাজের ধারণক্ষমতা ৫৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার ডিডব্লিউটি সম্পন্ন।
জাহাজ কেনার জন্য গত ৪ জুন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়, যা ১৫ জুলাই পর্যন্ত বিক্রি হয়। ১৬ জুলাই জমা পড়া প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই শেষে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন এবং সরেজমিন পরিদর্শন সম্পন্ন করা হয়। মোট আট প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করলেও প্রস্তাব জমা দেয় তিনটি। মূল্যায়ন শেষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। তাদের প্রস্তাবিত চীনে নির্মিত প্রতিটি জাহাজের মূল্য নির্ধারিত হয় ৩৮.৩৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিএসসি জানিয়েছে, বহরে যুক্ত হওয়া নতুন জাহাজ ‘এমবি বাংলার প্রগতির’ দৈর্ঘ্য ১৯৯ মিটার, ৩৩ মিটার প্রস্থ। ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজটি ৬৫ হাজার টন পণ্য পরিবহনে সক্ষম। এটির প্রধান ইঞ্জিন জার্মান লাইসেন্সের অধীনে নির্মিত এবং চীন সংযোজিত। পাম্প স্পেনের এবং কম্প্রেসার নরওয়ের। ইতিমধ্যে জাহাজটির ট্রায়াল রান হয়েছে চীনে। শিগগির এটি পণ্যবোঝাই করবে বিশ্বের এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে।
বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার বলেন, ‘লন্ডনে জাহাজটির কাগজপত্র হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি থেকে বিএসসি বুঝে নিয়েছিল। ডেলিভারি এবং গ্রহণের প্রটোকল উভয় পক্ষের দ্বারা যথাযথভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২৩ অক্টোবর এমভি বাংলার প্রগতি আনুষ্ঠানিকভাবে ডেলিভারি করেছে চীনা কোম্পানি। সেটি আমরা গ্রহণ করেছি।’
‘এমভি বাংলার প্রগতি’ সম্পর্কে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি গ্রিন শিপ কনসেপ্টে নির্মিত। নকশা ও প্রযুক্তিগত সমাধান জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানদণ্ডসম্মত। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা (আইএমও) নির্ধারিত সর্বশেষ পরিবেশগত মানদণ্ড পূরণ করে, যা বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাহাজগুলোর প্রধান ইঞ্জিন থেকে নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। জ্বালানি খরচ কম ও অপারেশনাল দক্ষতা বাড়ায়, যা সরাসরি অর্থনৈতিক সাশ্রয়ে প্রভাব ফেলে। হাইড্রোডাইনামিক ড্র্যাগ কমিয়ে জাহাজের গতি বৃদ্ধি ও জ্বালানি সাশ্রয় নিশ্চিত করে। বাতাসের বাধা কমিয়ে গতি ও জ্বালানি সাশ্রয় করে, বিশেষত উচ্চগতিতে চালানো যায়।’
বিএসসির নিজস্ব অর্থায়নে জাহাজ কেনা প্রতিষ্ঠানের ৫৩ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় জাহাজ আগামী ডিসেম্বরে বহরে যুক্ত হবে। এরপর আরও বেশ কিছু জাহাজ পর্যায়ক্রমে বহরে যুক্ত হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে বিএসসি। ১৯৭২ সালে ‘বাংলার দূত’ ও ১৯৭৩ সালে ‘বাংলার সম্পদ’ নামে জাহাজ যুক্ত হয় বিএসসিতে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএসসি এ পর্যন্ত ৪৪টি জাহাজ সংগ্রহ করে। বয়সের কারণে একের পর এক স্ক্র্যাপ হওয়া এবং দুর্ঘটনাজনিত কারণসহ ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩৯টি জাহাজ বিক্রি করা হয়। গেলো বছরের অক্টোবরে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ৩৭ বছরের পুরোনো এমটি বাংলার সৌরভ ও এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুটি স্ক্র্যাপ হিসেবে পরবর্তী সময়ে ৫৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হলে বিএসসিতে জাহাজের বহর নেমে আসে পাঁচটিতে। বর্তমানে বিএসসির বহরের জাহাজগুলো হলো- এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার অর্জন, এমটি বাংলার অগ্রগতি, এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা এবং এমটি বাংলার অগ্রদূত। সর্বশেষ যুক্ত হলো এমভি বাংলার প্রগতি। এর মধ্যে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৪৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা বার্ষিক মুনাফা করেছে বিএসসি। এটি সংস্থাটির ৫৩ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফার মাইলফলক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগের বছর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ২৪৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা মুনাফা পেয়েছিল।
