মিয়ানমারের সঙ্গে ৩ মাস ধরে বন্ধ আমদানি-রফতানি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ

মিয়ানমারের সঙ্গে ৩ মাস ধরে বন্ধ আমদানি-রফতানি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা

রাখাইনে সংঘাতের ফলে তিন মাসের বেশি সময় ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। এতে বন্দরে থাকা আলু, সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্য নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমদানি-রফতানিকারকরা। এ স্থবিরতা কবে কাটবে কেউ জানে না। ফলে ব্যবসায়ী, ট্রাকচালক, খালাসিরা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন। টেকনাফ থেকে গুটিয়ে অনেকে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা চালু করছেন।

আমদানি-রফতানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে তিন মাসের বেশি সময় ধরে। বলা যায় সীমান্ত বাণিজ্যে ধস নেমেছে। এতে স্থলবন্দরে থাকা আলু, সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বন্দরের শতাধিক ব্যবসায়ী।

বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বশেষ গত ১২ এপ্রিল আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে ১৩৮ পিসের একটি কাঠের বোট আসে। এরপর থেকে টেকনাফ-মংডু পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ। এ ছাড়া গত বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমার অংশের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইয়াঙ্গুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে চারটি পণ্যবাহী নৌযান আটক করে কমিশন দাবি করে আরাকান আর্মি। এরপর থেকে ছয় মাস ধরে ইয়াঙ্গুন দিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণা করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।

স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কোনও কর্মব্যস্ততা নেই। পুরো বন্দর খাঁ খাঁ করছে। রফতানির জন্য রাখা আলুতে পচন ধরেছে। টিনশেড একটি গুদামে বস্তায় বস্তায় আলু পচে পড়ে আছে। জেটি ঘাটে নেই কোনও পণ্যবাহী ট্রলার। কাজ না থাকায় বেকার দিন পার করছেন শ্রমিকরা।

বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বন্দরের কয়েকটি গুদামে দুই হাজার ৭০০ বস্তা আলু, ২২ হাজার ৮৫০ বস্তা সিমেন্ট, এক হাজার ৯০ বস্তা কোমলপানীয় রয়েছে। এ ছাড়া চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, প্লাস্টিক পণ্য মজুত আছে। এর মধ্যে সব আলু নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েক হাজার বস্তা সিমেন্টও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে নষ্ট হওয়ার পথে।

বন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সংঘাতের কারণে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে। এতে টেকনাফের ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় পড়েছেন। বাণিজ্য বন্ধ থাকায় রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৪৯ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে ২৯৫ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে সরকার। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানির বিপরীতে ৯১ কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। রাখাইনে সংঘাতের কারণে পণ্য আমদানি কম হওয়ায় রাজস্ব আদায় কমে গেছে। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় এক কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল দুই কোটি টাকা মূল্যের এক হাজার ৮২৮ মেট্রিক টন পণ্য।

স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে সাধারণত ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, জিরা, হিমায়িত মাছ, শুঁটকি, আচার, শুকনো সুপারি ও নারকেলসহ বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়। মিয়ানমার থেকে পণ্য আসা বন্ধ থাকায় দৈনিক চার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানিকৃত পণ্য থেকে ১১০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ ছাড়া পণ্য রফতানি হয় নয় লাখ ৯৭ হাজার টাকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি পণ্য থেকে ৪০৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। একই অর্থবছরে দুই লাখ ২৪ হাজার ডলারের বিভিন্ন পণ্য রফতানি হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছিল। তখন রফতানি হয়েছিল দুই লাখ ডলারের পণ্য। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে রাখাইন রাজ্যে সিমেন্ট রফতানি হয়েছে প্রায় চার হাজার ২৩৮ টন, আলু তিন হাজার ১৭৪ টন। গত ১২ এপ্রিল থেকে বাণিজ্য বন্ধ থাকায় প্রতিদিন চার কোটি টাকার মতো রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্থলবন্দরে অচল অবস্থা বিরাজ করছে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে বাণিজ্য বন্ধ আছে। বন্দরকে সচল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। আশা করছি, শিগগিরই বাণিজ্য কার্যক্রম চালু হবে।’

টিনশেড একটি গুদামে বস্তায় বস্তায় আলু পচে পড়ে আছে

আমদানিকারক এক্সপ্রেস এজেন্সির প্রতিনিধি মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধের পর তিন মাস ধরে পুরোপুরিভাবে আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। যদিও তার আগে মংডুর সঙ্গে ব্যবসা চালু ছিল। সেটিও এখন বন্ধ। এর প্রভাবে স্থলবন্দরে আমাদের আমদানিকৃত আলু পচে গেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সিমেন্টও। এতে শতাধিক ব্যবসায়ী বিপাকে পড়েছেন। জানি না কবে আবার স্থলবন্দরের ব্যবসা সচল হবে। তবে এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বন্দরে ব্যবসা চালু করেছেন।’

টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার জসিম উদ্দীন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন মাসের বেশি সময় ধরে বন্দর অচল। এতে মিয়ানমারে রফতানির জন্য বন্দরে মজুত করা ২২ হাজার ৮৫০ ব্যাগ সিমেন্ট, দুই হাজার ৭০০ বস্তা আলু, এক হাজার ৯০ বস্তা সফট ড্রিংকসসহ বিভিন্ন পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখানের জনবল অন্য খানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’  

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘মিয়ানমারের জলসীমায় সে দেশের বিদ্রোহী আরাকান আর্মি তল্লাশির নামে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে দেয়। এতে টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। আমরা সবাই মিলে বাণিজ্য চালুর চেষ্টা করছি।’

Source link

Related posts

৩ দিনের ছুটিতে কুয়াকাটায় হাজারো পর্যটক, খালি নেই হোটেল-মোটেল

News Desk

কক্সবাজারে এসে যা করলেন মীর

News Desk

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো প্রকৌশলীর

News Desk

Leave a Comment