মায়ের পর এবার ঈদের দিন বাবাকেও হারালো ৫ ভাইবোন
বাংলাদেশ

মায়ের পর এবার ঈদের দিন বাবাকেও হারালো ৫ ভাইবোন

দুই বছর বয়সী শিশু আছিয়া। কথা বলতে শেখেনি এখনও। কিছুই বুঝতে পারছে না। বাড়িতে শোকের মাতম, আছিয়া শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফুফু রহিমা বেগম তাকে কোলে করে রেখেছে। আছিয়াকে জন্ম দিয়েই তার মা অমিতা বেগম চলে যান না-ফেরার দেশে। মায়ের মৃত্যুর পর একদিন বয়স থেকেই আছিয়াকে লালন-পালন করছেন ফুফু রহিমা বেগম। এবার প্রতিপক্ষের লোকজন নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করলো আছিয়ার বাবা আকিদুল মোল্লাকে।

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঈদের দিন (৩ মে) দুপুরে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের চরদৈত্বেরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা শিশু আছিয়ার বাবা আকিদুল মোল্লাকে (৪৬) গোহাইলবাড়ি বাজারের পাশে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। আকিদুল গোহাইলবাড়ি বাজারে পাট ও ভুষি মালের ব্যবসা করতেন।

বাবাকে হারিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনাথ হয়ে গেলো আছিয়া। কোনোদিন মা-বাবা বলে ডাকতে পারবে না। শুধু আছিয়াই নয়, মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে গেলো তার আরও চার ভাই। আছিয়া সবার ছোট। আছিয়ার বড় ভাই আজিজুল (১৫) গোহাইলবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র; মেজো ভাই রিয়াজুল (১২) পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র; সেজো ভাই মুস্তাকিন (১০) চতুর্থ শ্রেণিতে এবং ছোট ভাই মমিন (৮) ব্র্যাকের শিশু শ্রেণিতে পড়ালেখা করে।

সরেজমিন দেখা যায়, শিশু আছিয়া তার ফুফু রহিমা বেগমের কোলে। বাড়িতে আহাজারি চলছে। নিহত আকিদুলের চার ছেলের কান্নাকাটিতে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। আকিদুলের বৃদ্ধা মা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। শুধু পরিবারের মানুষরাই নয় আশপাশের মানুষও কান্নাকাটি করছে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

আজিজুল বলে, ‘বাবা ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি আসে। তারপর দুপুরে বাড়ি থেকে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। গোহাইলবাড়ি বাজারের কাছে আসতেই আগে থেকেই ওত পেতে থাকা প্রতিপক্ষের লোকজন বাবার ওপর হামলা চালিয়ে কুপিয়ে জখম করে। বাবা ওই স্থানেই মারা যান।

‘দুই বছর আগে ছোট বোনের জন্মের সময় মা মারা যান। বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করলো ওরা। আমরা এতিম হয়ে গেলাম। আমাদের আর দেখাশোনার কেউ থাকলো না। আমার বাবাকে হত্যার বিচার চাই।’

নিহত আকিদুল মোল্লার ছোট ভাই দবির মোল্লা বলেন, ‘আমার ভাইয়ের সঙ্গে কারও কোনও ঝামেলা ছিল না। গ্রাম্য দলাদলি থাকলেও ভাই কখনও ঝামেলায় জড়াতো না। খুব নিরীহ মানুষ ছিল। ওরা আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করলো। মারপিটের সময় আমার ভাই ওদের বলেছিল, “আমার স্ত্রী বেঁচে নেই, আমাকে প্রাণে মারিস না। আমার ছেলেমেয়ে এতিম হয়ে যাবে। ওদের দেখার কেউ থাকবে না।” কিন্তু একথা শোনেনি তারা। ভাইকে এমনভাবে মেরেছে যে ওই স্থানেই মারা গেছে। হাসপাতালে নেওয়ারও সুযোগ হয়নি।

নিহত আকিদুল মোল্লার বোন রহিমা বেগম বলেন, ‘বড় ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে আছিয়াকে আমিই দেখাশোনা করি। মেয়েটার কপাল এতটাই খারাপ, জন্মের সময় মাকে হারালো, আবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবাকে হারালো। ওরা পাঁচ ভাইবোন এতিম হয়ে গেলো।’

নিহত আকিদুল মোল্লার বৃদ্ধা মা শাহিদা খাতুন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতে পারছেন না। একটু কথা বলছেন আর মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। আমার নাতি-নাতনিরা এতিম হয়ে গেলো। একজন মা বেঁচে থাকতে তার সন্তানের মৃত্যু কতটা কষ্টের, যে হারায় সেই বোঝে। আমার ছেলের বদলে আমাকে নিলে না কেনো আল্লাহ?’ বলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকেন তিনি।

জানা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোস্তফা জামান সিদ্দিকী ও গোহাইলবাড়ি এলাকার মৃত বজলুর রহমানের ছেলে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন বিবাদ চলে আসছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি গোহাইলবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচনে আরিফের পক্ষকে পরাজিত করে মোস্তফা জামান সিদ্দিকী সভাপতি নির্বাচিত হয়। এ ঘটনায় আরিফুজ্জামানের পক্ষের লোকজন ক্ষিপ্ত ছিল। ঈদের দিন দুপুরে গোহাইলবাড়ি বাজার সংলগ্ন এলাকায় মোস্তফা জামান সিদ্দিকীর সমর্থকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় আরিফের পক্ষের লোকজন।

হামলায় চরদৈত্বেরকাঠি গ্রামের মৃত হাসেম মোল্লার ছেলে আকিদুল মোল্লা, একই গ্রামের মৃত মোসলেম শেখের ছেলে খায়রুল শেখ (৪৭), মোস্তফা জামান সিদ্দিকীর দুই ভাই আলমগীর সিদ্দিকী (৫২) ও মাসুদ আহমেদ (৪০), রাজিবুল ইসলাম (৩০), কাদের মোল্লা (৪০), সোহেল শেখ (২০) গুরুতর আহত হন। তাদের বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক আকিদুলকে মৃত ঘোষণা করেন। অপর গুরুতর আহত খায়রুলকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে সাতৈর বাজারে পৌঁছালে পথিমধ্যে তিনি মারা যান।

গুরুতর আহত মোস্তফা জামান সিদ্দিকীর দুই ভাই আলমগীর সিদ্দিকী ও মাসুদ আহমেদকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল আলম বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঈদের দিন দুপুরে প্রতিপক্ষের লোকজন আকিদুল ও খায়রুল নামে দুই ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করে। এলাকায় ডিবি পুলিশ ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’ এলাকা এখন শান্ত রয়েছে বলে জানান তিনি।

আরও খবর: ঈদের দিনে ফরিদপুরে সংঘর্ষে প্রাণ গেলো ২ জনের

 

Source link

Related posts

একসঙ্গে ২ প্রেমিকাকে বিয়ে, সেই রোহিনীকে ডিভোর্স দিলেন এক স্ত্রী

News Desk

লকডাউনে পোশাক কারখানা খোলা রাখতে চায় বিজিএমইএ

News Desk

চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ৪ জনের মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment