মাছের আঁশ আনছে ডলার, আশার আলো দেখছেন ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ

মাছের আঁশ আনছে ডলার, আশার আলো দেখছেন ব্যবসায়ীরা

বাসাবাড়িতে উচ্ছিষ্ট হিসেবে মাছের আঁশ ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এটি এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাতে পরিণত হয়েছে। ঢাকার পাশাপাশি খুলনা ও চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর পরিমাণ মাছের আঁশ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। এটি সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে আশার আলো দেখছেন ব্যবসায়ীরা। 

এই আঁশ বিক্রি করে খুলনার অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ এখন স্বাবলম্বী। এই খাত থেকে এক বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা আয় হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ। 

খুলনা মহানগরের ময়লাপোতা সান্ধ্য বাজার, নতুন বাজার, বড় বাজার, মক্কি মসজিদের পাশে, শান্তিধাম মোড়, খালিশপুর বাজার, কেশবচন্দ্র কলেজ মোড়ে মাছের আঁশ ছাড়ানোর কাজ করছেন অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ। এই আঁশ রোদে শুকিয়ে বিক্রি করে এসব পরিবার এখন স্বাবলম্বী। তারা জানিয়েছেন, বাজারে মাছ কাটার পর যে আঁশ ফেলে দেওয়া হয়, সেসব এখানে যত্নসহকারে সংগ্রহ করছেন তারা। পরে সেগুলো শুকানো হয়। কারণ এগুলো ফেলনা নয়, বিদেশে রফতানি হয়। এর মাধ্যমে অনেকের জীবিকা চলছে।

সান্ধ্য বাজারে আঁশ ছাড়ানোর কাজ করা মো. রুস্তম আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে মাছ থেকে আঁশ ছাড়ানোর পর ফেলে দিলাম। গত দুই থেকে তিন বছর ধরে সংরক্ষণ করছি। এরপর রোদে শুকিয়ে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করি। চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিনিধিরা এসে কিনে নিয়ে যান। প্রতি কেজি শুকনো আঁশ বিক্রি করি ৫৫-৬০ টাকায়। তবে বছর দুয়েক আগে ১০০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।’

নতুন বাজার লঞ্চঘাট এলাকায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ কাটার কাজ করেছেন মো. মুন্না। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ছয়-সাত কেজি আঁশ হয়। সেগুলো শুকিয়ে সংরক্ষণ করি। ১০-১১ মাস পরে আনুমানিক ১০-১২ মণ হলে ব্যবসায়ীরা এসে প্রতিমণ ১২০০ টাকা দরে কিনে নেন। প্রতি মাসে বাড়তি আয় হয়।’

একই কথা জানিয়েছেন পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে মাছের আঁশ শুকানোর কাজ করা মো. সোহাগ। তিনি বলেন, ‘এগুলো ভেজা অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায় না, পোকা লেগে যায়। তখন কেউ কিনতে চান না। শুকিয়ে সংরক্ষণ করার পর ভালো দাম পাওয়া যায়। এতে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে।’

খুলনা রফতানি ব্যুরোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫-এর এপ্রিল পর্যন্ত চীনে দুই লাখ ১০ হাজার ১৭৯ ডলার মূল্যের মাছের আঁশ রফতানি হয়েছে। সাতটি সার্টিফিকেট অর্জন হয়েছে।

কোন কাজে লাগে মাছের আঁশ

মাছের আঁশে থাকা কোলাজিন ও জেলটিন প্রসাধনী, ওষুধ ও চোখের কৃত্রিম কর্নিয়া তৈরির পাশাপাশি জিন্স কাপড়ের উজ্জ্বলতা বাড়াতে ব্যবহার হয়ে থাকে। এগুলো ছাড়াও আঁশের বহু ব্যবহার রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে এই খাতটি আর সমৃদ্ধ হবে। এ ছাড়া এসব কাজের সঙ্গে জড়িতদের প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে রফতানি আয় দ্বিগুণ হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিন বিভাগের অধ্যাপক ড. শিকদার সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে মাছের আঁশ নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষত সারানো, হাড় জোড়া লাগানো, কোষের কাঠামো পুনর্গঠন, চোখের কর্নিয়ার পুনর্জন্ম, বিদ্যুৎ দিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পাদন, প্রসাধনী প্রস্তুতকরণ এবং নোংরা পানি শোধন। মাছের আঁশে প্রচুর প্রোটিন, মিনারেল ও জৈব উপাদান থাকায় এটি চিকিৎসা বিজ্ঞান, মাছ ও পোলট্রির খাদ্যশিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ মাছের আঁশ অপচয় হচ্ছে। আঁশ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত, বাজারজাতকরণ ও রফতানির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাবলম্বী করা সম্ভব। পাশাপাশি রফতানি আয়ও বাড়ানো সম্ভব।’

এজন্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. শিকদার সাইফুল বলেন, ‘যা এই শিল্পকে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্ররসারণে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে যদি উদ্যোক্তারা আঁশ প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে বিদেশ থেকে আমদানির প্রয়োজন হবে না। বরং এসব উপাদান দেশেই বিভিন্ন খাতে কাজে লাগানো যাবে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে অগ্রগতি আনবে এবং দেশীয় পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে।’

খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ কেজি মাছের আঁশ বিদেশে রফতানি হয়েছে। যার মাধ্যমে আয় হয়েছে তিন কোটি ৪১ লাখ ৫২০ টাকা। এর মধ্য দিয়ে এই পেশার সঙ্গে জড়িতরাও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।’

মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই হাজার ৬৯৮ দশমিক ৮৩ টন মাছের আঁশ রফতানি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৩২ লাখ তিন হাজার ১৬১ মার্কিন ডলার বা ৩৯ কোটি সাত লাখ ৮৫ হাজার ৬৪২ টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় চার হাজার টন আঁশ রফতানি করে আয় হয়েছিল ৯০ লাখ ডলার বা ১০৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম থেকে ১৯৫ দশমিক পাঁচ টন আঁশ ‘ফিস স্কেল’ নামে রফতানি হয়েছে। এতে আয় হয়েছে দুই লাখ ছয় হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় দুই কোটি ৫১ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৩৫২ টন, আয় হয়েছিল চার লাখ ১৮ হাজার ডলার বা পাঁচ কোটি ১০ লাখ টাকা। 

এ ছাড়া ঢাকা থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক হাজার ৯১৩ টন আঁশ রফতানি হয়েছে, যা থেকে আয় হয় ২৫ লাখ ৭৪ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে এই জেলা থেকে রফতানি হয়েছিল তিন হাজার ২৭ টন, আয় হয়েছিল ৭৯ লাখ ২২ হাজার ডলার বা ৯৩ কোটি টাকা। 

Source link

Related posts

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ১৩ কিলোমিটারে যানবাহনের ধীরগতি

News Desk

সিলেটে আন্দোলনে নিহত ২২ জনের দাফন ময়নাতদন্ত ছাড়াই, লাশ তোলা হবে ৯ জনের

News Desk

টঙ্গীতে সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ৬৯

News Desk

Leave a Comment