পাইলট সাগরের বাসায় স্বজনদের কান্না
বাংলাদেশ

পাইলট সাগরের বাসায় স্বজনদের কান্না

ঢাকায় বিধ্বস্ত হওয়া প্রশিক্ষণ বিমানের নিহত পাইলট তৌকির ইসলাম ওরফে সাগর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তি ইউনিয়নের কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামে তোহরুল ইসলামের ছেলে। তার মৃত্যুর খবরে ওই এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তৌকিরদের গ্রামের বাড়ি হলেও তার পরিবার প্রায় ২৫ বছর ধরে রাজশাহী নগরীর উপশহরে ভাড়া থাকেন। ওই বাড়ির সামনে ভিড় করছেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা। স্বজনদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। এ বাসায় তৌকিরের বাবা তহুরুল ইসলাম, মা সালেহা খাতুন ও বোন বৃষ্টি খাতুন থাকেন।

মনিরা খাতুন নামের নিহত পাইলটের আরেক আত্মীয় বলেন, এর আগে যশোরে প্রশিক্ষণ বিমান যখন বিধ্বস্ত হয়ে তার ব্যাচ মেট মারা গিয়েছিল। তখনই তার বাবা-মা চেয়েছিল বিমানে তার চাকরি করতে নিষেধ করেছিল। কারণ ওই প্রশিক্ষণ বিমানে তারও ওঠার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই দিন প্রশিক্ষণ বিমানে কী কারণে ওঠা হয়নি, তাই সেই ধাক্কায় সাগর বেঁচে যায়। কিন্তু সাগরের পাইলটের চাকরিটা পছন্দ ছিল। এরপর তার বাবা-মা বলেছিল। তুমি যেটা ভালো মনে করছো, তোমার ওপরেই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু সাগর এবার বাঁচলো না। বিয়ে এক বছর আগে করেছিল। কিন্তু ঢাকায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছয় মাস আগে হয়েছে। তার বউ ক্যাডেট কলেজের ছাত্রী ছিলেন। পরে পাস করে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। তাদের বাড়ি গাজীপুর জেলায়। সাগরের বাবা পাথরের ব্যবসা করতেন।

আনোয়ার হোসেন নামের এক প্রতিবেশী তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আজ একটি হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি আমাদের গর্ব, একজন সাহসী পাইলট তৌকির ইসলাম সাগর ভাইকে। তিনি আমার পাশের বাড়ির ছেলে। তার বাবার নাম তোহরুল ইসলাম ও দাদার নাম রুস্তম আলি (রুস্তম ঠাকুর)। কৃষ্ণচন্দ্রপুর, চককীর্তি, শিবগঞ্জ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই অপূরণীয় ক্ষতিতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন এবং শোকাহত পরিবারকে এই কঠিন সময়ে ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করুন। সবাইকে অনুরোধ, দয়া করে তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করুন।’

নিহত পাইলটের আত্মীয় কাওসার আহমেদ বলেন, ‘আমার খালুর আপন ভাতিজা নিহত পাইলট সাগর। আমি ফরিদপুরে চাকরি করি। আমাদের গ্রাম থেকে জানানো হয় আমাদের সাগর মারা গেছেন।’

আবদুল্লাহ আল মামুন নামের আরেকজন তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার শিক্ষকতা জীবনের দ্বিতীয় বছরের  ছাত্র।  কত মেধাবী এই ছেলেটা, আমি যখন ক্লাসে ইংরেজি পড়াতাম, তখনই উপলব্ধি করেছিলাম! খুবই কষ্ট হচ্ছে।  আমি শিক্ষক হিসেবে দোয়া করি… (শাহীন ক্যাডেট রাজশাহী শাখা শোকাহত) বিমানে বিধ্বস্ত নিহত পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর ছিলেন রাজশাহী ল্যাবরেটরি স্কুলের ১৪তম ব্যাচের ছাত্র। তার বাসা রাজশাহী উপশহরে।’

তোহরুল ইসলামের গাড়িচালক আলী হাসান বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবরে স্যাররা ঢাকায় গেছেন বিশেষ বিমানে। বিকাল ৫টা ১৮ মিনিটে বিশেষ একটি ফ্লাইটে রাজশাহী হযরত শাহ মখদুম বিমানবন্দর থেকে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সঙ্গে গেছেন তৌকিরের স্ত্রী, বোন সৃষ্টি খাতুন ও তার স্বামী ডা. তুহিন ইসলাম। এ ছাড়া বাড়িতে তৌকিরের চাচাতো মামা রফিকুল ইসলাম ছাড়া কেউ নেই।’

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িতে কেউ নেই। তৌকিরের দুর্ঘটনার খবরে সবাই ঢাকা গেছে। তার জন্য দোয়া করা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। তারা সবাই মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। তৌকিরের স্ত্রী ঢাকায় সরকারি কোয়ার্টারেই থাকেন।’

রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এ রকম ভালো ছেলে আমি আর দেখিনি। সেই ছেলেকে এভাবে হারিয়ে ফেলবো বুঝিনি।’

রাজশাহীর বাসার মালিক আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘তৌকির ইসলাম সাগর প্রথমবারের মতো একা প্রশিক্ষণ বিমান চালাবেন এই খবরে পুরো পরিবারের সদস্যরা আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত ছিলেন। দুপুরের পর তারা বিমান বিধ্বস্তের খবর পান। সে সময় জানতে পারেন সাগর ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সাগরকে দেখতে পরিবারের সদস্যরা বিমানযোগে ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে র‌্যাবের একটি মাইক্রোবাসে করে ভাড়া বাসা থেকে তাদের রাজশাহী শাহমখদুম বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তারা ঢাকা রওনা হন।’

স্বজনেরা জানান, তৌকিরের বাবা তহুরুল ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা। তিনি আমদানি-রফতানির ব্যবসা করেন। প্রায় ২৫ বছর আগে থেকেই তিনি রাজশাহীতে বসবাস করেন।

তৌকির রাজশাহীর নিউ গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনার পর পাবনা ক্যাডেট কলেজে ৩৪তম ব্যাচে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ২০১৬ সালে তিনি ক্যাডেট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। বছরখানেক আগে তিনি বিয়ে করেন। তৌকিররা দুই ভাই-বোন। ছোট বোন বৃষ্টি একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী।

তৌকিরের মৃত্যুর খবর শুনে বাড়ির সামনে এসেছেন পাবনা ক্যাডেট কলেজের তার প্রশিক্ষক মোস্তাক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সে খুব মেধাবী ছিল। ভীষণ মিশুক ও শান্ত ছেলে ছিল। তার কথা এখন খুব মনে পড়ছে। সে ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করতে জানত।’

তৌকির ইসলাম রাজশাহীর সপুরায় গেল বছর থেকে তিনতলা একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। বাড়িটির কাজ এখনও চলমান।

উল্লেখ্য, তৌকির ইসলাম সাগর সোমবার দুপুরে বিমান বাহিনীর যে প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে, তার একমাত্র পাইলট ছিলেন তিনি। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় তৌকির প্যারাসুটে অবতরণ করতে পারলেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি সিএমএইচে মারা গেছেন।

সফল উড্ডয়নের পরও এই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে অনেক ছাত্রছাত্রীর নিহত ও আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে এবং ভর্তি করা হয়েছে।

Source link

Related posts

চট্টগ্রামে ৫২ জনের করোনা শনাক্ত 

News Desk

এখন সত্য কথা বলা পাপ: রিজভী

News Desk

পেঁয়াজের কেজিতে ৪ টাকা লোকসান কৃষকের

News Desk

Leave a Comment