দিনে সড়ক দুর্ঘটনা, রাতে ডাকাত আতঙ্ক
বাংলাদেশ

দিনে সড়ক দুর্ঘটনা, রাতে ডাকাত আতঙ্ক

গাজীপুরের মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কটির দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এ সড়ক জেলার শ্রীপুরের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত মাওনা চৌরাস্তা এবং কালিয়াকৈরে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শাল-গজারি বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কটি যানজটমুক্ত হওয়ায় অনেকে এ সড়ক ব্যবহার করে থাকেন। সম্প্রতি দিনে সড়ক দুর্ঘটনা এবং রাতে ডাকাতির ঘটনায় সড়কটি হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক। রাত হলেই ডাকাত দল গজারি গাছ কেটে সড়কে ফেলে রাখে। আটকা পড়ে যানবাহন। এরপর ডাকাত দল সর্বস্ব লুটে নিয়ে যায়। আর দিনে নানা কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।

সড়কে চলাচলকারী চালক, যাত্রী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতে ডাকাত আতঙ্ক এবং দিনে দুর্ঘটনার ভয় মাথায় নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে তাদের। সন্ধ্যার পর থেকেই সড়কে গাছ ফেলে যাত্রীবাহী সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার থামিয়ে হানা দিচ্ছে ডাকাতরা। সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকাত দলের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় জড়িত। কেউ পোশাক কারখানায় খণ্ডকালীন কাজ করে। আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করে বা অটোরিকশা চালায়। তারাই রাতের বেলা হয়ে ওঠে ভয়ংকর।

মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কে পিকআপ রেখে ব্যারিকেড দিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। ৩০ জুলাই দিবাগত রাত ১টায় শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের ওই সড়কে এ ঘটনা ঘটে। ওই সড়কের হাসিখালি ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে রাত ১০টার পর প্রায়ই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে বলে জানান স্থানীয়রা। ডাকাত দল গাজীপুর জেলা শ্রমিক দলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শরীফুল ইসলাম সরকারের (৪০) গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। ডাকাতরা হামলা করে তার গাড়িচালক মইনুলকে (৩১) কুপিয়ে আহত করে এবং তাদের কাছে থাকা নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয়। এ ঘটনায় পরদিন সকালে শরীফুল ইসলাম শ্রীপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

গত বছরের ৩ মার্চ মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কে রাত ২টার দিকে সিংগারদিঘি গ্রামের হাসিখালি ব্রিজ এলাকায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাত দলের সদস্যরা টহলরত পুলিশের ওপর হামলা করে। ডাকাতদের দায়ের কোপে শ্রীপুর থানার পুলিশ কনস্টেবল রুহুল আমিন (২৫) ও সেলিম (৩৫) আহত এবং পুলিশের ধাওয়ায় দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় চলন্ত ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে ডাকাত সদস্য রুবেল মিয়া (২৭) আহত হয়। রুবেল শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। সে আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ।

একই বছরের ১২ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসিখালী ব্রিজ এলাকায় গাছ ফেলে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েকজন ব্যবসায়ীর টাকাপয়সা লুট করে নেয় ডাকাতরা। ওই বছরের ৪ আগস্ট বদনীভাঙ্গা মোড়ে গাছ ফেলে ডাকাতি হয়। একই বছরের ১৮ নভেম্বর একযোগে সড়কের তিনটি পয়েন্টে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

চলতি বছরের ৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই সড়কের হাশিখালি সেতুর পশ্চিম পাশে সড়কে গজারি গাছ ফেলে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহম্মদ আব্দুল বারিক বলেন, ‘বিগত দুই-এক বছরে ঘটে যাওয়াসহ সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ডাকাতির ঘটনাস্থল চিহ্নিত করে ওইসব স্থানে পুলিশ টহল জোরদার এবং সড়কের কয়েকটি স্থানে স্থায়ী টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক বলেন, ‘মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কে পুলিশের টহল অব্যাহত আছে। ডাকাতি রোধে পুলিশকে এখন থেকে আরও সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

৩২ কিলোমিটারে ২০ ভয়ংকর বাঁক, সাত মাসে ১০ জনের প্রাণহানি

শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং মাওনা চৌরাস্তার প্রাইভেট হাসাপাতালের জরুরি বিভাগের ভর্তি ও মৃত্যু বিবরণী থেকে পাওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে সড়কটির ২০ জায়গায় বিপজ্জনক বাঁকে অর্ধ শতাধিক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। আহতদের মধ্যে অনেকে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

চলতি বছরের ১৪ জুন বদনীভাঙ্গা (মনসুরাবাদ) এলাকায় চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় সড়কে ছিটকে পড়ে শিমলাপাড়া গ্রামের আহাম্মদ আলীর ছেলে মুরগি ব্যবসায়ী মোটরসাইকেল চালক হারুনুর রশিদ (৩৫) এবং আরোহী জাকির হোসেন (৩৮) নিহত হন।

১৮ জুলাই দুপুরে বড়চালা এলাকায় কাভার্ডভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের তিন জনসহ পাঁচ জন নিহত হন।

১৯ জুলাই ওই সড়কের চাপার সেতুর দক্ষিণ পাশে সড়ক পার হওয়ার সময় সিমেন্ট মিক্সার গাড়ির চাপায় উপজেলার শিমুলতলী গ্রামের রাদের ছেলে ওষুধ ব্যবসায়ী রৌদ্র পাল (২৫) নিহত হন। ১৫ ফেব্রুয়ারি সড়কের কাওরান বাজার এলাকায় রাশেদ ও আবু বক্কর ছিদ্দিক নামের দুই ব্যক্তি নিহত হন।

চালক যাত্রী ও এলাকাবাসী বলছেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও বাঁকে দুর্ঘটনা ঘটছে। ৩৭ কিলোমিটার সড়কে ১৭টি ভয়ংকর বাঁকে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত সাত মাসে দুর্ঘটনায় ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। তবু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না।

সরেজমিন দেখা যায়, এ এলাকায় অন্তত ১৭টি ভয়ংকর বাঁক আছে। এসব বাঁকে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ বাঁকে কোনও কার্যকর সংকেতচিহ্ন নেই। যেটুকু সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে, তাও অস্পষ্ট এবং দূর থেকে দেখা যায় না।

সিএনজি চালক জব্বার মিয়া বলেন, ‘সড়কে গাড়ি ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলে। ইচ্ছা করলেই গাড়ি হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বাঁকগুলো এত ভয়ঙ্কর যে এক পাশ থেকে অন্য পাশ দেখা যায় না। বাঁকগুলোতে যে নির্দেশক দেওয়া আছে, তা অস্পষ্ট এবং দূর থেকে দেখা যায় না। বিশেষ করে রাতের বেলা সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।’

আরেক চালক কবির হোসেন বলেন, ‘মূলত এ ধরনের বড় বাঁকে কনভেক্স মিরর স্থাপন করা উচিত, যাতে চালকরা দূর থেকে আসন্ন বাঁকের বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন দেখতে পারেন এবং দুর্ঘটনা এড়াতে পারেন। সংকেত বাতি স্থাপন করা হলে সমস্যা থাকবে না।’

সড়কটির মাওনা থেকে ফুলবাড়ীয়া পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে সওজের গাজীপুর কার্যালয়। কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহেল মিয়া বলেন, ‘সড়কের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে সংকেত বাতি স্থাপন করতে না পারলেও “ডানে মোড়,” “বামে মোড়” লিখে সিগন্যাল দেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করবো আমরা। সড়কে স্পিড ব্রেকার (গতি রোধক) দেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সড়কটির ১৩ কিলোমিটারের ওই অংশের বাঁকগুলোর ঝুঁকি বিবেচনায় দুর্ঘটনা রোধে র‌্যাম্বেল স্ট্রিপ (ঘন ছোট গতিরোধক) দিয়ে দেবো যাতে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।’ এ ছাড়া যেসব এলাকার সড়ক নির্দেশক মুছে গেছে, সেগুলো দ্রুতই ঠিক করা হবে বলে জানান তিনি।

Source link

Related posts

ব্রহ্মপুত্রে গোসলে নেমে ভাইবোনসহ ৪ শিশু নিখোঁজ

News Desk

টিআর-কাবিখার চাল ব্যবসায়ীদের গুদামে, পাচ্ছেন না শ্রমিকরা

News Desk

অনলাইন ট্রান্সফার ও আন্তঃব্যাংক চেক লেনদেন বন্ধ

News Desk

Leave a Comment