তেল পরিবহনে নতুন যুগে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ

তেল পরিবহনে নতুন যুগে বাংলাদেশ

জ্বালানি পরিবহন খাতে নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইনে জ্বালানি তেল যাবে। সফল প্রাক-কমিশনিংয়ের পর প্রস্তুত করা হয়েছে পাইপলাইন। ফলে আগে ঢাকায় জ্বালানি পরিবহনে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা লাগতো, সেখানে পাইপলাইনে এখন সেটা ১২ ঘণ্টা লাগবে। এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খরচ সাশ্রয় হবে। বাঁচবে সময়ও।

প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে শনিবার (১৬ আগস্ট) উদ্বোধন করা হবে। পতেঙ্গার ডেসপাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেল পরিবহনের পাইপলাইন প্রকল্প উদ্বোধন করবেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ মেজর জেনারেল মু. হাসান-উজ-জামান। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী আমিনুল হক। উদ্বোধনের পর নদীপথে অয়েল ট্যাংকারের পরিবর্তে পাইপলাইনে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা ডিপোতে জ্বালানি সরবরাহ হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতাসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত, সিস্টেম লস কমানো, নৌপথে তেল পরিবহনের বিপুল খরচ সাশ্রয়, পরিবেশ সুরক্ষা, ঝুঁকিমুক্তভাবে দ্রুত সময়ে তেল পরিবহনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। তিন হাজার ৬৫৩ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করা হয় প্রকল্প। সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রায় ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরু করতে ২০২০ সাল লেগে যায়। পরে ২০২২ সালের ডিসেম্বর এবং তৃতীয় দফায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। চলতি বছরের মার্চে কাজ শেষ হয়। এতে খরচ বেড়ে হয়েছে তিন হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা।

প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ২৪১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন এবং গোদনাইল থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত ১০ ইঞ্চি ব্যাসের ৮ দশমিক ২৯০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। সবমিলিয়ে ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন গেছে দেশের ২২টি নদী ও খালের মধ্য দিয়ে। এজন্য মোট নয়টি পাম্পিং স্টেশন তৈরি হয়েছে, যার জন্য ২৮৬ দশমিক ৮৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর এবং মুন্সীগঞ্জ হয়ে ঢাকায় পরিবহন সহজ করার জন্য কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার মোগবাড়িতে একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয় ডিপো তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পদ্মা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এবং ফতুল্লায় যমুনা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের রিজার্ভার বসানো হয়েছে।

বিপিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এতদিন তেল পরিবহনে শতাধিক কোস্টাল ট্যাংকারে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগতো। এখন ১২ ঘণ্টায় তেল নারায়ণগঞ্জের ডিপোতে যাবে। তা ছাড়া খারাপ আবহাওয়ার কারণে নৌপথে ট্যাংকারে তেল পরিবহন বিঘ্নিত হতো এবং ঝুঁকির সৃষ্টি হতো। পাইপলাইন সে সমস্যার সমাধান করে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পরিবেশবান্ধব, ঝুঁকিমুক্ত, পরিবহন ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ী ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ২৪২ কিলোমিটার লাইনে চট্টগ্রাম থেকে প্রতি ঘণ্টায় ২৬০-২৮০ টন ডিজেল যাবে গোদনাইল ডিপোতে।

বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, গত ২২ জুন পতেঙ্গা গুপ্তখাল থেকে পদ্মা অয়েল কোম্পানির দুই ট্যাংকের ১৮-২০ হাজার টন ডিজেল পাইপলাইনে গোদনাইল ডিপোতে পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছিল। এরপর মেঘনা অয়েল কোম্পানির দুটি ট্যাংকারে ১৬-১৮ হাজার টন ডিজেল পাঠানোর কাজ শুরু হয়। সবকিছু স্বয়ংক্রিয় স্ক্রিনে মনিটরিং করা হয়েছে, পাইপলাইনে তেল পাঠাতে কোনও জটিলতা হয়নি। এই লাইনে ঘণ্টায় ৩২০ টন জ্বালানি পাঠানোর সক্ষমতা থাকলেও প্রাথমিক পর্যায়ে ঘণ্টায় ২৬০-২৮০ টন পাঠানো হয়েছে। পদ্মা, মেঘনার পর পাইপলাইনে তেল যায় যমুনার। একই লাইনে তেল গেছে কুমিল্লার ডিপোতেও। এর মধ্য দিয়ে অপারেশনাল সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও প্রকল্প হস্তান্তর প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানি পিএলসি (পিটিসিপিএলসি) ও প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি তদারকি করছেন।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের উপ-ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) শ্যামল পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইনের কাজ শেষ হওয়ার পর গত জুন মাস থেকে পরীক্ষামূলক তেল পরিবহন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে যেসব ছোটখাটো ত্রুটি ধরা পড়েছে, তা ইতিমধ্যে সমাধান করা হয়েছে। আগামী ১৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হবে।’

এর মধ্য দিয়ে তেল পরিবহনে দেশে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে জানিয়ে শ্যামল পাল বলেন, ‘ওই দিন দেশের ইতিহাসে পাইপলাইনে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে তেল যাবে। এর মাধ্যমে তেল পরিবহনে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। পরিবেশবান্ধব, ঝুঁকিমুক্ত এই কাজে পরিবহন ব্যয় ও সময় সাশ্রয় হবে।’

চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইল পর্যন্ত ডিজেল সরবরাহের একাধিক সফল ট্রায়াল হয়েছে বলে জানালেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লার ডিপো থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিপোতে জ্বালানি পাঠানো যাবে। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে জ্বালানি পৌঁছাতে লাগবে ১২ ঘণ্টা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় অয়েল ট্যাংকারে তেল পরিবহনে প্রতি বছর বিপিসির ব্যয় হয় ৩২৬ কোটি টাকা। কিন্তু পাইপলাইন চালু হলে পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ হবে ৯০ কোটি টাকা। এতে বছরে অন্তত ২৩৬ কোটি টাকা বিপিসির সাশ্রয় হবে। সেইসঙ্গে পাইপলাইনে পরিবহন করা হলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’

পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যানিং অ্যান্ড অপারেশন্স) জামান নাহীদ রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাইপলাইনে চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইল ডিপোতে তেল পরিবহন ট্যাংকারের পরিবর্তে পাইপলাইনের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এতে সময় এবং অর্থের সাশ্রয় হবে।’

Source link

Related posts

নীলফামারীতে জমে উঠেছে ঈদের বাজার

News Desk

মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসে ‘খেলনা পিস্তল’ নিয়ে আটক দুই যুবক

News Desk

এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি জামালপুর জেলা কারাগার, রাতেও থেকে থেমে চলছে গুলি

News Desk

Leave a Comment