বহুল প্রতীক্ষিত সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হলেও তা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে স্বস্তির বদলে হতাশার জন্ম দিয়েছে। কারণ জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে সড়কটি। স্থানীয়রা বলছেন, এই উন্নয়নকাজ টেকসই হবে না। বরং কয়েক মাসের মধ্যেই বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যাবে সড়কটি। জলে যাবে প্রকল্পের তিন কোটি টাকার বেশি।
জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পে নেই জলবায়ু পরিকল্পনা
সাতক্ষীরার পোস্ট অফিস মোড় থেকে হাটখোলা মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় আছে। সড়ক দিয়ে দিনে হাজারো শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করতে হয়। অবশেষে জলবায়ু অর্থায়নের আওতায় নির্মাণ শুরু হলেও মূল সমস্যা উপেক্ষিত থাকছে। অল্প বৃষ্টিতেই সরকারি কলেজ মাঠ ও আশপাশের এলাকায় হাঁটুসমান পানি জমে যায়। সম্প্রতি বৃষ্টিতেই কলেজ ক্যাম্পাসসহ শহরের বড় অংশ প্লাবিত হয়েছিল। সড়কটি নতুন করে তৈরি করা হলেও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের প্রকল্পে যদি জলবায়ুর পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরন ও নগরীর পানি প্রবাহের চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় না নেয়, তবে তাকে জলবায়ু সহনশীল বলা যায় না।
প্রকল্পের কাজ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন জেলা জলবায়ু পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বছরের ছয়-সাত পানিতে ডুবে থেকে এই এলাকার অধিক রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর। তারপরও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সড়ক কোনোভাবেই টিকবে না।’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন
সাতক্ষীরা পৌরসভা প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার মেইনস্ট্রিমিং প্রজেক্টের’ আওতায় সাতক্ষীরা পৌরসভা উন্নয়ন প্রকল্প ২০২৪-২০২৫-এর অধীনে পোস্ট অফিস মোড় থেকে পুরাতন সাতক্ষীরা হাটখোলা মোড় পর্যন্ত সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হয়। সড়কের প্রস্থ দুই পাশে তিন মিটার করে থেকে ছয় মিটার বাড়ানো হয়েছে। ২০২৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ২০ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় তিন কোটি আট লাখ ৬৮ হাজার ৭৫৭ টাকা।
‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার মেইনস্ট্রিমিং’ বলতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য অবকাঠামোগত পরিকল্পনা এবং নির্মাণে স্থিতিস্থাপক নকশা ও কৌশল অন্তর্ভুক্ত করাকে বোঝায়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু-সংক্রান্ত ঝুঁকি, যেমন—চরম আবহাওয়া, বন্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—থেকে অবকাঠামোকে রক্ষা করা, যা দীর্ঘমেয়াদে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি কমায় এবং টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করে। এটি মূলত একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত ঝুঁকিগুলো ভবিষ্যতের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পোস্ট অফিস মোড় থেকে পুরাতন হাটখোলা পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে পৌরসভার তৎকালীন মেয়র আব্দুল জলিলের মেয়াদকালে এটি শেষবারের মতো পিচ ঢালাই করা হয়। এরপর চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে ২০২৩ সালে ২০ লাখ টাকায় সংস্কার করা হয়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। ২০২৪ সালে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে পুনরায় সংস্কার করা হলেও বৃষ্টির পানি জমে সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি বেশিরভাগ সময় থাকে জলাবদ্ধ
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ রোডটি জেলার প্রাণ হিসেবে পরিচিত। এই রোড সংলগ্ন এলাকায় জেলা প্রশাসক ও জেলা জজের বাসভবন। এ ছাড়া একই এলাকায় রয়েছে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ, গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়, প্রধান ডাকঘর, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, জেলা সমবায় কার্যালয়, বিটিসিএল কার্যালয়, সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, সমাজসেবা কার্যালয়, জাতীয় মহিলা সংস্থা, মোসলেমা আদর্শ একাডেমি, পল্লীমঙ্গল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হোস্টেল, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোচিং সেন্টার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দফতর। গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি বছরের বেশিরভাগ সময় সড়কটি জলাবদ্ধ থাকায় চলাচলে সবাইকে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
নির্মাণকাজ শুরু পর হতাশা
নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় প্রাথমিকভাবে আশার আলো দেখলেও পরে কাজের ধরন দেখে হতাশ হয়েছেন স্থানীয় লোকজন। মূল সমস্যা হলো ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি না করা হয়। বারবার সংস্কার করা হলেও কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা এখনও তৈরি করা হয়নি। বিশেষ করে সরকারি কলেজ মাঠ এবং মোসলেমা আদর্শ একাডেমির সামনের অংশে সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটুসমান পানি জমে যায়। একটু বৃষ্টি হলেই সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসসহ শহরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। যা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। পানি চলাচলের জায়গা না থাকায় দিনের পর দিন জলাবদ্ধ থাকে। তার ওপর দিয়ে চলাচল করতে হয় স্থানীয়দের। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে নির্মাণ করা সড়কটি ছয় মাসও টিকবে না বলে জানান এলাকাবাসী।
স্থানীয়দের ক্ষোভ
শহরের রাজারবাগান এলাকার বাসিন্দা ও তরুণ লেখক মুতাছিম বিল্লাহ সুমন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সড়কের দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে কংক্রিটের ড্রেন নির্মাণ খুবই জরুরি ছিল। কারণ বর্ষায় সড়কটি ডুবে যায়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ২০ ফুট চওড়া হওয়ার কথা থাকলেও সব স্থানে সমান প্রশস্ত হচ্ছে না। এ ছাড়া সড়কটির ভেতর থেকে গাছ, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি সরানো হয়নি।
নতুন সড়কটি ছয় মাসও টিকবে না বলে জানালেন সরকারি কলেজ সড়কের বাসিন্দা ও জেলা উদীচীর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পানি চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধ অবস্থা থাকে বেশিরভাগ সময়। ফলে যতবারই সংস্কার করা হয়, ততবারই সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে সড়কের দুই পাশে ছয় ফুট বাড়ানো হয়েছে। তবু ড্রেনেজের জন্য জায়গা রাখা হয়নি। অবৈধ স্থাপনা দিয়ে সড়কের অনেক জায়গা দখল করা হয়েছে, সেগুলো সরানো হয়নি। বিশেষ করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সড়ক টিকবে না।’
প্রকল্পে ড্রেন নির্মাণের কথা নেই
সড়ক নির্মাণের ঠিকাদারি কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন পটুয়াখালীর কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ ও মিজানুর আলম (জেভি)। ঠিকারদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মো. শিহাব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র সড়কের কাজের দায়িত্ব পেয়েছি। প্রকল্পে ড্রেন নির্মাণের কোনও কথা উল্লেখ নেই। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে আমরা দ্রুত কাজ করছি। তবে বিদেশি প্রকল্প হওয়ায় প্রতিটি ধাপে পরীক্ষা ও অনুমোদন নিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছে। এজন্য সময় বেশি লাগছে। এ ছাড়া জনবহুল এলাকা হওয়ায় একসঙ্গে অনেক শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে পারছি না। সড়কে নির্মাণসামগ্রী রাখলে চলাচলে অসুবিধা হয়, তাই কাজ দ্রুত করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।’
ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছাড়া সড়ক করা মানেই অর্থ অপচয়
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আজাদ হোসেন বেলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই সড়কে যে খোয়া ফেলা হয়েছে, তার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে আমাদের। জলবায়ু প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, অথচ টেকসই কোনও সমাধান হচ্ছে না। ড্রেন ছাড়া সড়ক সংস্কার মানেই অর্থের অপচয়।’
সড়ক নির্মাণের এক বছর পর শুরু হবে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ
প্রকল্পের কনসালট্যান্ট প্রকৌশলী মিরাজ আহম্মেদ বলেন, ‘জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড এবং বাংলাদেশ সরকার। এটি শুধুমাত্র সড়ক নির্মাণের জন্য। এতে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোনও কাজ অন্তর্ভুক্ত নেই। তবে আলাদা ‘ড্রেন প্যাকেজ’ রয়েছে, যা প্রায় এক বছর পরে শুরু হবে। সেখানে ৩৫-৪০টি ড্রেন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। তবে জায়গা সংকটের কারণে সব স্থানে করা সম্ভব হবে না। অনেক সরকারি জায়গা স্থানীয় লোকজন দখল করে রেখেছেন, তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কাজ সম্পন্ন হলে পানি নিষ্কাশনের সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে।’
সরকারি কলেজ মোড় থেকে মোসলেমা একাডেমি পর্যন্ত সড়কটি পানিতে তলিয়ে থাকে উল্লেখ করে প্রকল্পের কনসালট্যান্ট প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘আর্থিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা এই দৃশ্য দেখে সড়কটিতে আরসিসি ঢালাইয়ের প্রস্তাব করেছেন। আমরা সেই প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি এবং অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।’
যা বলছেন পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্পে ড্রেনেজ ব্যবস্থা আছে কিনা, তা আমার জানা নেই। শহরের ভেতর দিয়ে ১০টি ড্রেনেজ প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে ওই সড়কও থাকতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে পোস্ট অফিস থেকে ৮৫০ মিটার কার্পেটিংয়ের কাজ আগামী এক মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। বাকি অংশটুক আমরা চেষ্টা করছি আরসিসি ঢালাই দেওয়ার জন্য। এটা অবশ্যই কিছুটা দেরিতে হবে। আরসিসি ঢালাইয়ের জন্য আলোচনা করছি।’