আমনের ভরা মৌসুমে কুড়িগ্রামের কয়েকটি স্থানে সার সংকটের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করছেন কৃষকরা। কৃষকদের অভিযোগ, ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) এবং ইউরিয়া সারের জন্য ডিলার পয়েন্ট ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরছেন তারা। এতে আমন ক্ষেতসহ রবিশস্যের আগাম আবাদ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে কৃষি বিভাগের দাবি, জেলায় সারের পযাপ্ত মজুত আছে। এ বছর বন্যা না হওয়ায় দু-একটি উপজেলার নিচু অঞ্চলে ধান এবং আগাম সবজি চাষের প্রস্তুতি চলছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আবাদ করছেন কৃষকরা। ফলে সারের চাহিদা বেড়েছে। এটা সংকট নয়, বরাদ্দের তুলনায় হঠাৎ চাহিদা বেশি হওয়ায় এমনটা ঘটেছে।
বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না। কিছু দোকানে সার মিললেও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে নিতে হচ্ছে। ডিলারদের যোগসাজশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সার না পেয়ে কৃষকদের বিক্ষোভ
সার সংকটের অভিযোগে ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ী উপজেলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কৃষকরা সড়কে নেমে এসেছেন। গত রবিবার ভূরুঙ্গামারীতে এবং মঙ্গলবার নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলায় সারের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন কৃষকরা। কিছু এলাকায় সারের অতিরিক্ত দামেরও অভিযোগ আছে।
কৃষকরা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। মৌসুমের শুরুতে জেলা জুড়ে ডিএপি সারের সংকট থাকলেও এখন সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউরিয়া সংকট। আমন ধানের পাশাপাশি কিছু উপজেলায় শীতকালীন আগাম সবজির চাষ শুরু হওয়ায় সারের চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলায় সার সংকট নিয়ে কৃষকদের মাঝে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ, ডিলাররা কৃষকদের সার না দিয়ে মুনাফার লোভে খুচরা বিক্রেতাদের হাতে সার তুলে দিচ্ছেন। দিনের পর দিন ডিলার পয়েন্টে সারের জন্য ধরনা দিতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে কিছু সার মিললেও চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না। সংকটে দুর্বল হচ্ছে রোপা আমন, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আগাম শীতকালীন সবজি চাষ।
আমন ধানের পাশাপাশি তিন বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করেছেন ভূরুঙ্গামারীর পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাইকডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মঞ্জু মিয়া। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমপক্ষে চার বস্তা সার দরকার আমার। কিন্তু দুই সপ্তাহ ঘুরে এক বস্তা সার পাইছি। রবিবার থাকি বাজার ঘুরে আর সার পাচ্ছি না।’
একই অভিযোগ করেছেন পাইকেরছড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘এই এলাকার ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষক। এখন ভরা মৌসুমে কৃষকরা সার পাচ্ছেন না।’
নাগেশ্বরী উপজেলার কেদার ইউনিয়নের বাহের কেদার গ্রামের কৃষক ইসমাইল হোসেন জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছেন। তার কমপক্ষে ৬০ কেজি সার প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না।
মঙ্গলবার সকালে নাগেশ্বরী উপজেলার কচাকাচা বাজারে কয়েকশ কৃষককে সারের জন্য জড়ো হতে দেখা যায়। পরে সকাল ১০টার দিকে পুলিশ পাহারায় কৃষকপ্রতি ১৫ থেকে ২০ কেজি করে সার দেওয়া হয়। একই দিন সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রতিবাদে জেলা শহরের শাপলা চত্বরে মানববন্ধন করে রাষ্ট্র সংস্কার কৃষক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন।
সারের ‘সংকট নেই’ বলছে কৃষি বিভাগ
কৃষি বিভাগ বলছে, সারের সংকট নেই। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আমন আবাদ হয়েছে। বন্যা না হওয়ায় নিচু অঞ্চলেও চাষাবাদ হয়েছে। কৃষকরা আগাম শীতকালীন সবজি চাষ শুরু করায় সারের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তবে এটি সংকট নয়।
কৃষি বিভাগের সন্দেহ, যৌগিক সার ডিএপির জন্য কৃষকদের চাহিদার কারণে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। নেপথ্যে থেকে কেউ কেউ কৃষকদের উসকানি দিচ্ছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে কৃষি বিভাগ। পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুড়িগ্রামের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যা না হওয়ায় এখনও অনেকে আমন রোপণ করছেন। নিচু এলাকাগুলোতে এবার চাষাবাদ হয়েছে। অনেক কৃষক আগাম শীতকালীন সবজি চাষ শুরু করেছেন। নিয়মিত চাহিদার তুলনায় এ বছর সারের চাহিদা একটু বেশি। ফলে চাপটা একসঙ্গে পড়ে গেছে। তবে সংকট নেই।’
‘আমাদের এখনও সারের যে মজুত আছে, তা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে বেশি। কিছু ব্যবসায়ী পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আবার অনেকে সংকট ভেবে আতঙ্কে বেশি করে সার কিনে রাখার চেষ্টা করছেন। তৃতীয় পক্ষ কৃষকদের উসকানি দিয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে থাকতে পারে। আমরা ডিলার পয়েন্টগুলোতে মনিটরিং করে উত্তোলন করা সারের সঙ্গে মজুত যাচাই করছি’ বলে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।
কৃষকদের উদ্দেশে উপপরিচালক বলেন, ‘ধানক্ষেতে এখন ডিএপি সার লাগার কথা নয়। ডিএপি জমি প্রস্তুতের সময় প্রয়োগ করতে হয়। এই সার ফসলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। আমন ক্ষেতে এই সময়ে ডিএপি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন আমন ক্ষেতে ডিএপি দিলে ফলনের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতে পারে। রোগ ও পোকামাকড় বাড়বে। ইউরিয়া ও এমওপি দেওয়া যেতে পারে। আমরা মাঠে থেকে কৃষকদের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ কিছু জায়গার চাহিদা বাড়ায় বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।