কক্সবাজারে ঘুরতে এসে পাহাড়ি আস্তানায় বন্দি, একজনের তথ্যে ৮৩ জন উদ্ধার
বাংলাদেশ

কক্সবাজারে ঘুরতে এসে পাহাড়ি আস্তানায় বন্দি, একজনের তথ্যে ৮৩ জন উদ্ধার

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পান্টি গ্রামের রেজাউল করিম বেড়াতে এসেছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফে। উঠেছিলেন স্থানীয় হোটেল আল করমে। সেখানে ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে ৭ সেপ্টেম্বর তাকে অপহরণ করে মো. আমিন নামের এক ব্যক্তি। যিনি হোটেলটির সাবেক ম্যানেজার। আমিন তাকে ৫০ হাজার টাকায় পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ওই পাচারকারীরা আরেক পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে টেকনাফের বাহারছড়া কচ্ছপিয়ার গহিন পাহাড়ের আস্তানায় আটকে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করা হয়। 

রেজাউলের ভাষ্যমতে, টেকনাফ পৌর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের ঝরনা চত্বর থেকে সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ কয়েকজন ব্যক্তি অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে চোখ বেঁধে ফেলে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম অপহরণের শিকার হয়েছি। চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায় পাহাড়ি আস্তানায়। সেখানে ৫০ হাজার টাকায় মানব পাচারকারীদের হাতে আমাকে তুলে দেয় অপহরণকারীরা। এরপর ওই আস্তানায় আটকে মুক্তিপণের জন্য অমানবিক নির্যাতন করা হয়। ১৩ দিন ধরে চলছিল নির্যাতন। সর্বশেষ গত শনিবার আমাকে ৬০ হাজার টাকায় আরেক দল পাচারকারীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তারা আমাকে কচ্ছপিয়ার গহিন পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে যাই। এভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলাম। শেষে জীবন বাঁচাতে ছুটে যাই বিজিবির কাছে। তারা আমাকে নিরাপদে তাদের আশ্রয়ে নিয়ে যায়।

রেজাউলের দেওয়া তথ্যে ৮৩ জনের প্রাণ রক্ষা

রেজাউল একা ফেরেননি, তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রক্ষা পেয়েছে আরও ৮৩ জনের প্রাণ। কচ্ছপিয়ার গহিন পাহাড়ে যৌথ অভিযান চালিয়ে গত রবিবার নারী-শিশুসহ আরও ৮৩ জনকে উদ্ধার করেছে র‍্যাব-বিজিবি। উদ্ধারকৃতদের সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারের জন্য আস্তানাটিতে জড়ো করা হয়েছিল। পাশাপাশি অস্ত্র-গুলিসহ তিন মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৮৩ জনকে উদ্ধারের বিষয়ে সোমবার দুপুরে টেকনাফ ২ বিজিবির সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান ও র‍্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান অভিযানের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। এ সময় বিজিবি কার্যালয়ে রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। বেঁচে ফেরার বিস্তারিত জানান রেজাউল।

পাহাড়ের আস্তানার বর্ণনা দিয়ে রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন আস্তানায় নিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হলো তখন দেখলাম চারপাশে দুই শতাধিক মানুষ বন্দি। তারা পাহাড়ে গড়েছে অন্ধকার এক রাজ্য। যেখানে মানুষের জীবনের কোনও মূল্য নেই, দাম আছে টাকার। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় আমার ওপর নির্যাতন। পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন চালায় পাচারকারীরা। একইভাবে অন্যদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়। একপর্যায়ে অপহৃতদের পরিবারের কাছে ফোন দিয়ে কথা বলিয়ে কিংবা নির্যাতনের শব্দ শুনিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণ না পেলে মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয় তারা। আমি যেদিন পালিয়ে আসছিলাম সেদিনও তাদের আস্তানায় ২৫০ জনের মতো মানুষ ছিল। পরে আমার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিজিবি ও র‌্যাব অভিযান চালায়। আস্তানা থেকে ৮৩ জনকে উদ্ধার করা হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘পরে জেনেছি হোটেল আল করমের ম্যানেজার আমিন আমাকে অপহরণ করে ৫০ হাজারে বিক্রি করে দেয়। প্রতিনিয়ত এখানে আসা লোকজনকে অপহরণ করা হয়। এখনও ওই আস্তানায় শতাধিক মানুষ বন্দি আছে। তাদেরও উদ্ধার করা উচিত। না হলে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা বলা কঠিন।’

যা বলছেন হোটেল আল করমের মালিক

হোটেলটির ম্যানেজার অপহরণে জড়িত এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল আল করমের মালিক মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি আমাদের পারিবারিক হোটেল। ১০ বছরের জন্য অন্যদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এখন যারা হোটেল চালান, তারা আমিনের বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ম্যানেজার আমিনকে দুই বছর আগে হোটেল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। সে বর্তমানে আমাদের হোটেলের কেউ নয়।’

একই আস্তানা থেকে টেকনাফের নয়াপাড়ার বাসিন্দা আয়েশা খাতুনকে উদ্ধার করা হয়। গত সপ্তাহে এক পরিচিত নারীর সঙ্গে পাহাড়ে ঘুরতে এসে অপহরণের শিকার হন। আয়েশা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘোরাঘুরি করার সময়ে টেকনাফ থেকে আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। পরে মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা আমাকে পাহাড়ের আস্তানায় আটকে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন চালায়। এখানে আরও অনেক মানুষকে বন্দি অবস্থায় দেখতে পাই। একটি ঝুপড়ি ঘরে আমাদের গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল। অনেক নির্যাতন ও কষ্টে ছয় দিন পার করেছি। অবশেষে বিজিবির অভিযানে আমরা উদ্ধার হয়েছি। যদি আমরা উদ্ধার না হতাম হয়তো মৃত্যুর মুখে পড়তাম। আসলে এখান থেকে ফেরার কোনও সুযোগ নেই।’

তাদের মতো অপহরণের শিকার হন মুন্সীগঞ্জ সদরের অমিত হাসান ও মানিক মিয়া। মুন্সীগঞ্জে তাদের পরিচয় হয় কক্সবাজারের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তারই আমন্ত্রণে দুজন কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন। টেকনাফে বেড়াতে নেওয়ার কথা বলে অমিত ও মানিককে মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন কক্সবাজারের ওই বাসিন্দা। এরপর পাচারকারীরা সাগরপথে থাইল্যান্ডে পাচারের জন্য দুজনকে টেকনাফের পাহাড়ের ভেতরের একটি আস্তানায় আটকে রাখেন। ২০ দিন পর র‍্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে উদ্ধার হয়েছেন তারা।

বিজিবি-র‍্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে রেজাউল করিম, আয়েশা খাতুন, অমিত হাসান ও মানিক মিয়াকে জোর করে পাচারকারীদের ওই আস্তানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। অন্যদের আস্তানাটিতে নিয়ে আসা হয় নানা প্রলোভনে। এর মধ্যে অনেককে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে উন্নত জীবনযাপন ও চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়েছে। কয়েকজন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। উদ্ধার করা ৮৪ জনের ৬৬ জনই রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। এর মধ্যে রেজাউল করিম সেখান থেকে পালিয়ে এসে বিজিবিকে তথ্য দেন। পরে সেখানে অভিযান চালানো হয়।

সাগরপথে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে পাচার

অভিযানে উদ্ধার হয়েছেন উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ এনাম (২২) এবং আমিন বাহার (২৪)। তারা ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। তারা জানিয়েছেন, ক্যাম্পের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আট বছর পার হয়ে গেলো, তাদের দেশে ফেরার কোনও সুরাহা হচ্ছে না। পাশাপাশি সম্প্রতি ক্যাম্পে অপহরণের ঘটনা বাড়ছে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে মিলে ক্যাম্প থেকে বের হন। তাদের বলা হয়েছিল, উন্নত জীবনযাপন ও মালয়েশিয়ায় চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু পাহাড়ের আস্তানায় এনে তাদেরও বিক্রি করে দিয়েছে মানব পাচারকারীরা। এরপর আস্তানায় আটকে নির্যাতন চালানো হয়।

মোহাম্মদ এনাম বলেন, ‘ক্যাম্পের পরিচিত এক দালালের মাধ্যমে টেকনাফে পৌঁছি। এরপর আমাদের পাহাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে দেখি আরও অনেক মানুষ বন্দি। কথা ছিল মালয়েশিয়া পৌঁছালে দুজন মিলে ছয় লাখ টাকা দিতে হবে। কিন্তু দালাল আমাদের পাঠানোর কথা বলে পাহাড়ে ১০ দিন আটকা রাখে। পরে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না পাওয়ায় মারধর করা হয়। যারা মুক্তিপণ দেয় তাদের আলাদা করে রাখা হয়।’

একই আস্তানা থেকে টেকনাফের নয়াপাড়ার বাসিন্দা আয়েশা খাতুনকে উদ্ধার করা হয়

১২ ঘণ্টা ধরে পাহাড়ে অভিযান

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান জানিয়েছেন, পাহাড়ের ওই আস্তানায় অভিযান শুরুর পর পাচারকারীরা যৌথ বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে তিনটি গুলি ছোড়ে। এ সময় কিছু ভুক্তভোগীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পালাতে চেয়েছিল তারা। তবে পুরো পাহাড়টি ঘিরে ফেলে কৌশলে ভুক্তভোগীদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়। প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় তিন জনকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা মূলত মানব পাচারকারী।

তিন মানব পাচারকারী গ্রেফতার 

গ্রেফতার তিন মানব পাচারকারী হলো- টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া এলাকার সালামত উল্লাহর ছেলে আবদুল্লাহ (২১), রাজরছড়ার আবুল হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (২০), একই এলাকার মো. ফিরোজের ছেলে মো. ইব্রাহিম (২০)। তাদের কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, একটি একনলা বন্দুক, একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি দেশি রামদা, একটি চাকু ও তিনটি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা হয়েছে। সোমবার বিকালে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।

মানব পাচারকারী কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয়

বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘টেকনাফের পাহাড়ে মানব পাচারকারী বেশি কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় হয়েছে। ফলে আমরা নজরদারির মাধ্যমে পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করছি।বাংলাদেশে অবস্থানরত হোসেন, সাইফুল ও নিজাম নামের তিন ব্যক্তি; আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত দালালদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েকটি চক্রও পাচারের সঙ্গে জড়িত আছে। তাদের ধরতে আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি পাহাড়ে বিভিন্ন আস্তানায় আমাদের এ অভিযান চলমান থাকবে।’

এক সপ্তাহে ১৭৭ জনকে উদ্ধার

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে নদী ও পাহাড়ের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে পাচারের উদ্দেশ্যে জড়ো করে আটকে রাখা ১৭৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১২ জন মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখনও অভিযান অব্যাহত আছে।

Source link

Related posts

যে কারণে বিলুপ্তির পথে নাটোরের কাঁসাশিল্প

News Desk

তিন লাখ মানুষের সেবায় ৪ জন চিকিৎসক

News Desk

‘ত্রাণ নয়, একটা বেড়িবাঁধ চাই’

News Desk

Leave a Comment