উদ্ভাবনের ৫ বছরেও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ দিতে পারছে না বিনা
বাংলাদেশ

উদ্ভাবনের ৫ বছরেও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ দিতে পারছে না বিনা

পেঁয়াজ, মরিচ ও রসুনের কিছু উচ্চ ফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবনের দীর্ঘদিন পরেও ফসলগুলো চাষাবাদের আওতায় আনতে পারেনি ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। কৃষকরা আগ্রহী হয়ে যোগাযোগ করলেও বীজ স্বল্পতায় সরবরাহ করতে পারছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে বীজের এই সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, উন্নত জাতের এসব ফসল চাষ করতে কৃষকরা বেশ আগ্রহী। অনেকে বীজ সংগ্রহের জন্য নিয়মিত ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু বীজ স্বল্পতার কারণে দেওয়া হচ্ছে না। বীজ সংকট কাটিয়ে উঠতে বিনার প্রদর্শনী মাঠে বিস্তর জায়গাজুড়ে এসব মসলার ফসল চাষ করা হয়েছে।

বিনার উদ্ভাবিত মসলার জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বিনা পেঁয়াজ-১, বিনা পেঁয়াজ-২, বিনা মরিচ-১ ও বিনা রসুন-১। এছাড়া নতুন উদ্ভাবিত বিনা হলুদ-১ জাতটিও ছড়িয়ে দিতে নানা পরিকল্পনা করছেন গবেষকরা। চাষের আওতায় আনতে প্রথমে বীজ উৎপাদনের দিকেই জোর দেওয়া হচ্ছে।

গবেষকরা জানান, শুধু শীতকালে পেঁয়াজ উৎপাদন করে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মেটানো সম্ভব না। এ জন্য গ্রীষ্মকালে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে ২০০৬ সাল থেকে গবেষণা শুরু হয়। গবেষণার ধারাবাহিকতায় উন্নত বৈশিষ্ট্যের হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য ২০১৮ সালে বিনা পেঁয়াজ-১ ও বিনা পেঁয়াজ-২ নামে অনুমোদন দেয় জাতীয় বীজ বোর্ড।

বিনা মরিচ-১ জাতের ফলন (গ্রিন চিলি) প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৫ টন পাওয়া যায়। জাতটি স্থানীয় জাতের তুলনায় ১৩০ থেকে ১৪০ ভাগ বেশি ফলন দেয়। আর বিনা রসুন-১ জাতটি প্রতি হেক্টরে ১৩ থেকে ১৫ টন উৎপাদন করা সম্ভব। যা অন্যান্য জাতের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি। বিনা মরিচ-১ ও বিনা রসুন-১ জাতগুলো উদ্ভাবনের জন্য ২০১২ সাল থেকে গবেষণা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ফলন পরীক্ষায় সন্তোষজনক হয়। ওই বছরই জাতীয় বীজ বোর্ড বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন দেয়।

বিনা পেঁয়াজ-১ ও বিনা পেঁয়াজ ২ খরিফ-১ মৌসুমে অর্থাৎ কন্দ উৎপাদন মৌসুমে এ দুই জাতের পেঁয়াজে তেমন কোনও পোকামাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ হয় না। এ জাত অন্য জাতের চেয়ে অধিক কন্দ ও বীজ উৎপাদনে সক্ষম। এ ছাড়া এগুলোর কন্দের সংরক্ষণকাল স্বাভাবিক অবস্থায় দুই মাস বা তার চেয়ে বেশি এবং একই বছরে বীজ থেকে বীজ উৎপাদন করা সম্ভব, যা দেশে অন্য জাতের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। উদ্ভাবিত এই দুই জাতের পেঁয়াজ হেক্টর প্রতি ৮ থেকে ১০ টন উৎপাদন হবে।

রবি মৌসুমে অক্টোবর থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহকে নির্ধারণ করে জমিতে বীজ বপন করতে হবে। খরিপ-১ মৌসুমে (গ্রীস্মকালীন ফসল) কন্দ (পেঁয়াজের চারা) উৎপাদনের জন্য মধ্য জানুয়ারিতে বীজ বপন করতে হবে।

উচ্চ ফলনশীল বিনা হলুদ

এ ছাড়া রবি মৌসুমে বীজের জন্য চারা রোপণ করলে অবশ্যই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্য ডিসেম্বরেই (অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চতুর্থ সপ্তাহ) করতে হবে। খরিফ-১ মৌসুমে কন্দ উৎপাদনের জন্য চারা রোপণ করতে হবে মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ (ফাল্গুনের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহ) পর্যন্ত।

বিনা মরিচ-১ ও বিনা রসুন-১ এর উদ্ভাবক বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম। তিনি বীজ স্বল্পতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, উদ্ভাবনের পরের বছর আমাদের কাছে পর্যাপ্ত বীজ ছিল। কিন্তু তখন কৃষকরা না জানার কারণে চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তখন থেকেই জাতগুলো সম্পর্কে কৃষকদের অবগত করার বিষয়ে জোড় দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরে কৃষকদের পর্যাপ্ত বীজ দেওয়া হয়েছে। তারা এগুলো চাষ করে লাভবান হওয়ায় বীজ সংগ্রহের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত বীজ না থাকায় দিতে পারছি না।

তিনি বলেন, আগামী বছর উচ্চ ফলনশীল এসব মসলা সারা দেশের বেশিরভাগ জেলায় চাষের আওতায় আনতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এজন্য বীজ উৎপাদনের দিকেই মনোযোগ দেওয়া হয়েছে

মরিচের জাতটি সম্পর্কে ড. রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৫ টন পাওয়া যায়। জাতটি স্থানীয় জাতের তুলনায় ১৩০ থেকে ১৪০ ভাগ বেশি ফলন দেয়। ঝাল তুলনামূলকভাবে কম ও সুগন্ধিযুক্ত এবং সাকুলেন্ট (পানি শোষণের ক্ষমতা)। এ গাছটি আকারে খাটো ও ঝোপালো। প্রথম মরিচ সংগ্রহের পর গাছে ফলনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এটি আকারে বড় ও মাংসল।

উচ্চ ফলনশীল বিনা মরিচ

চারা লাগানোর মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর গাছে ফুল আসা শুরু করে এবং পরবর্তী ২৮ দিনের মধ্যে কাঁচা মরিচ পাওয়া যায়। সাধারণত এভাবে ৯ থেকে ১২ বার কাঁচা মরিচ তোলা যায়।

এ ছাড়া বিনা রসুন-১ প্রচলিত জাতের তুলনায় কার্যক্ষমতা বেশি। রোপণের পর মাত্র ১৩৫ থেকে ১৪৫ দিনের মধ্যে রসুন ঘরে তোলা যায়। আকারে বড় হওয়ায় উৎপাদন বেশি হয়। এর প্রতিটি রসুনের কন্দে ২৪ থেকে ৩০টি কোয়া থাকে। উৎপাদন খরচ অনেক কম এবং রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের চেয়ে খুবই কম। ঝাঁজ বেশি হওয়ায় রান্নায় রসুনের পরিমাণও লাগবে কম।

বিনা হলুদ-১ সম্পর্কে বলেন, ২০১৭ সালের শুরুতে পুরোদমে গবেষণা শুরু হয়। ২০১৯ সালে সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। একই বছর জাতীয় বীজ বোর্ড কৌলিক সারিটিকে বিনা হলুদ-১ নামে নিবন্ধন করে। কারণ নতুন জাতটি প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৩ টন ফলন হয়। যা প্রচলিত জাতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এতে গাঢ় হলুদ ও শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ শতকরা ৩৮ থেকে ৪০ ভাগ। এটি পাহাড়ি ও সমতলে চাষ উপযোগী। সেদ্ধ করে শুকালে রঙের পার্থক্য হয় না এবং রান্নায় তিতাভাব থাকে না। লিফ ব্লচ ও রাইজোম রট রোগসহনশীল। বপনের ৩১০ দিনের মধ্যে ফলন সংগ্রহ করা যায়।

বিনা মরিচ

তিনি বলেন, জাতটি নতুন হলেও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত বীজ ছিল। কিন্তু কৃষকরা জাতটি সম্পর্কে দ্রুত অবগত হওয়ায় নিজেরাসহ অনেকের মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন। আমরা স্বল্পমূল্য, আবার কোথাও বিনামূল্যেও বীজগুলো দিয়েছি। এজন্য বর্তমানে বীজের পরিমাণ কম। তবুও বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে হলুদের নতুন জাতটি ছড়িয়ে দেওয়া অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও বিনা পেঁয়াজ-১ ও বিনা পেঁয়াজ ২ এর উদ্ভাবক ড. আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে নিরলসভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কৃষকদের মাঝে উদ্ভাবিত বীজগুলো ছড়িয়ে দিতে আমাদের চেষ্টা চলছে। এজন্য বীজ উৎপাদনের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উচ্চ ফলন হওয়ায় কৃষকরা একবার চাষ করলে বারবার চাষ করতে চাইবে। তাই জাতগুলো ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশে মসলার ফলন উৎপাদনে বিপ্লব ঘটবে।

Source link

Related posts

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে ভিক্ষুকের লাশ উদ্ধার

News Desk

সাগর উত্তাল, ঘাটে ফিরেছে মাছ ধরার শত শত ট্রলার

News Desk

করোনা নিয়ে কাদেরের কবিতা

News Desk

Leave a Comment