‘গলায় টিউমারের অপারেশনের পর ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে ময়মনসিংহে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। তারপরও পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। কেমোথেরাপি দিতেই ধারকর্জ করতে হয়েছিল। রেডিও থেরাপির খরচ জোগাতে জমি বন্ধক দিয়ে কিছু সংগ্রহ করি, আশপাশের মানুষ সহযোগিতা করেন। এরপর আরও এক লাখ টাকা ধার করে ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে দেড় মাস রেডিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। ময়মনসিংহ মেডিক্যালে রেডিও থেরাপি মেশিন ভালো থাকলে হয়তো ঢাকায় যেতে হতো না।’
এসব কথা বলছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের চিকিৎসা নিতে আসা হালুয়াঘাট উপজেলার সাঁকুয়াই গ্রামের দর্জি গোপাল চন্দ্র (৫২)। নিজের ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘একমাত্র ভিটাবাড়ি ছাড়া এখন আর কিছুই নেই। শরীর দুর্বল হওয়ায় দর্জির কাজ করতে পারি না। আয়-রোজগার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলের ভরণপোষণ করাতে এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। এরপরে এখন চিকিৎসক কীভাবে করবো এই চিন্তায় ঘুম আসে না। ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ক্যানসার বিভাগের রেডিওথেরাপি মেশিনটি ভালো থাকলে আমাদের মতো গরিব মানুষদের এত টাকা খরচ করে ঢাকায় যেতে হতো না।’
শুধু গোপাল চন্দ্র না, ক্যানসারে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী ও স্বজনদের একই কথা। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে রেডিওথেরাপি মেশিন গত দশ বছর ধরে বিকল হয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন এ অঞ্চলের বহু রোগী।
জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শেরপুরের নকলা থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা জুবাইদা বেগম (৫২) বলেন, ‘তিন মাস আগে জরায়ুতে সমস্যা দেখা দেওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে অপারেশন করতে হয়েছে। এরপরে অপারেশনের জায়গায় ক্যানসার শনাক্ত হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে দেড় মাসের মতো সময় ধরে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ হইনি। এখন চিকিৎসক বলছেন রেডিও থেরাপি দিতে হবে। ময়মনসিংহ মেডিক্যালে রেডিও থেরাপি মেশিন বন্ধ থাকায় ঢাকায় যাওয়ার জন্য রেফার্ড করেছে। ঢাকা মেডিক্যালেও রেডিও থেরাপি মেশিন নষ্ট। আছে শুধু পিজি হাসপাতাল ও ক্যানসার হাসপাতালে। কিন্তু এই দুই সরকারি হাসপাতালে রেডিও থেরাপি দেওয়ার সিরিয়াল সহজে পাওয়া যায় না। এজন্য বেশির ভাগ ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে অনেক টাকা খরচ করে রেডিওথেরাপি দিতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় প্রাইভেট হাসপাতালে রেডিও থেরাপি দেওয়ার জন্য প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীর স্ত্রী আমি। কেমোথেরাপি এবং অন্যান্য চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন রেডিও থেরাপি দেওয়ার টাকা কোত্থেকে জোগাড় হবে এই ভাবনায় ঘুম আসে না। ময়মনসিংহ মেডিক্যালে রেডিও থেরাপি মেশিন চালু থাকলে হয়তো এত টাকা লাগতো না।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম পাঠান বলেন, ‘প্রতিদিন হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের আমরা কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি, ইমিউনো থেরাপি দিয়ে থাকি। এ ছাড়া ক্যানসারের সার্জারি চিকিৎসা করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোবাল্ট ৬০ রেডিও থেরাপি মেশিনটি গত ১০ বছর ধরে নষ্ট হয়ে বন্ধ অবস্থায় আছে। এটি চালু করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনও চেষ্টাই কাজে আসেনি। প্রতিদিন আমরা ১০ থেকে ১২ জন রোগীকে রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করে থাকি। তবে ঢাকায় গিয়ে সরকারি হাসপাতালে সিরিয়াল পেতে খুবই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আর প্রাইভেট হাসপাতালে রেডিও থেরাপি দেওয়াটা খুবই ব্যয়বহুল। অনেক গরিব রোগী অর্থের অভাবে এই চিকিৎসা করাতে পারেন না।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডাক্তার মাইনুদ্দীন খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আধুনিক মানের স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যানসার বিভাগের জন্য নতুন ভবনের কাজ চলমান আছে। কাজ শেষ হলে এখানে আধুনিক মানের রেডিওথেরাপি মেশিন বসানোসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থাকবে।