অনেকটাই বিলুপ্তির পথে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী সাদা বা ধবল গরু। এই গরু মিরকাদিমকে সবার কাছে পরিচিত করে তুলেছিল। একসময় ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য পুরান ঢাকার ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে থাকতো। তবে দিন দিন সংখ্যা কমতে কমতে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্রেতাদের চাহিদাও আগের মতো নেই। সেই সুদিন হারিয়ে গেছে। এখন নামেমাত্র কয়েকজন এই জাতের গরু লালন-পালন করেন। ঈদুল আজহা ঘিরে সে কয়েকজন খামারি গরু পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সরেজমিনে মিরকাদিমের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সাদা গরুর খামারিদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। তারা জানালেন, অনেকটাই বিলুপ্তির পথে সাদা গরু। কেন বিলুপ্তির পথে জানতে চাইলে খামারিরা বললেন, মূলত লালন-পালনের খরচ এবং গরু মোটাতাজাকরণের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো সেই চাহিদাও নেই। সুদিনও নেই। তবু বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে দুই-চার জন খামারি দু’চারটি করে এই জাতের গরু পালন করছেন। ছোট পরিসরে ধরে রেখেছেন বংশপরম্পরার ঐতিহ্য।
সাদা গরুর বৈশিষ্ট্য
চোখের পাপড়ি সাদা, শিং সাদা, নাকের সামনের অংশ সাদা, পায়ের খুর সাদা, লেজের পশম সাদা, আর সারা শরীর তো সাদা আছেই। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে বিক্রি একটি আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়।
একসময় ছিল পুরান ঢাকার প্রধান আকর্ষণ
একসময় কোরবানির ঈদের প্রধান আকর্ষণ ছিল এই গরু। বিক্রির জন্য পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের হাটের (গণি মিয়ার হাট) প্রচলন শুরু হয়েছিল শত বছর আগে। মিরকাদিমের দুই শতাধিক খামারি কয়েক হাজার গরু নিয়ে হাটে যেতেন। কিন্তু গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও ইনজেকশন দিয়ে গরু মোটাতাজাকরণের প্রতিযোগিতায় ঐতিহ্য হারিয়েছেন খামারিরা। বর্তমানে খামারির সংখ্যা নেমেছে দুই-চার জনে। এখন দলবেঁধে রহমতগঞ্জের হাটে যান না তারা। পুরান ঢাকার কেউ কেউ শখের বসে খামারে এসে পছন্দ করে সাদা গরু কিনে নিয়ে যান।
যে জন্য আলাদা
কোরবানির ঈদের জন্য মিরকাদিমের গরুগুলোকে আলাদা করা হতো। খামারিদের নিজস্ব মিলে ভাঙানো খৈল, বুট, খেসারি, গম, চালের গুঁড়া, ভুট্টা ভাঙা, মসুর ডালের ভুসি, কাঁচা ঘাস ও রাব (মিষ্টিগুড়) খেতে দেওয়া হয়। তবে দেওয়া হয় না কোনও ধরনের ইনজেকশন কিংবা মোটাতাজাকরণের ওষুধ। একেবারে প্রাকৃতিকভাবে পালন করা হয়। তাই এই গরুর মাংসে আঁশ কম। একটু নরম ও তেলতেলে হয়। তবে পালনে খরচ বেশি। দামও অন্যান্য গরুর চেয়ে বেশি। বর্তমানে এক থেকে সর্বোচ্চ চার-পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।
যেসব কারণে পেশা ছেড়েছেন খামারিরা
৩০ বছর ধরে সাদা গরু লালন-পালন করেছেন মিরকাদিম পৌরসভার কাগজিপাড়া এলাকার মো. সাফিন দেওয়ান। এখন তার পরিবারের কেউ পালন করেন না। কারণ জানতে চাইলে সাফিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তিন ভাই দীর্ঘ ৩০ বছর সাদা গরু লালন-পালন করেছি। তার আগে বাবা-চাচা পালন করতেন। আমরা তাদের কাজে সাহায্য করতে করতে এই পেশায় এসেছিলাম। গত পাঁচ বছর ধরে করছি না। কারণ গোখাদ্যের দাম যেমন বেড়েছে আবার কাঁচা ঘাস তেমন নেই। একটা সময় পরিবারের নারীরা এই কাজে সাহায্য করতেন। এখন সবাই আধুনিক। আমাদের বয়স হয়েছে। দূর থেকে ঘাস কেটে আনা সম্ভব হয় না। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন চাকরি করে, তাদের পক্ষে বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখা সম্ভব নয়। সময়ের পরিবর্তনে এভাবেই দিন দিন খামারি কমে যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে সাদা গরু লালন-পালনের ঐতিহ্য।’
যা বললেন খামারিরা
মিরকাদিমে ‘মজিবর অ্যাগ্রো লিমিটেড’ নামে খামার দিয়ে সাদা গরু পালন করছেন মো. ইমন হালদার। পাশাপাশি ‘শাহীন অ্যাগ্রো লিমিটেড’ নামে একই গরুর খামার দিয়েছেন শাহীন আহমেদ। গত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাদা গরু কিনে সনাতন পদ্ধতিতে লালন-পালন করছেন তারা।
ইমন হালদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিরকাদিমের ঐতিহ্যবাহী সাদা গরু আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে লালন-পালন করে আসছি। এখনও ঐতিহ্য ধরে রাখতে ৫০টি পালন করছি। প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করা হয়। ক্রেতারা আসতে শুরু করেছেন। আমার খামারে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকার গরু আছে।’
শাহীন অ্যাগ্রো লিমিটেডের কর্মচারী আলী আজগর বলেন, ‘মূলত পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এসে এখান থেকে গরুগুলো পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান। আমাদের ফার্মে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা দামের গরু আছে। বেচাকেনা ভালো। ক্রেতারা আসছেন। দেখছে পছন্দ হলে কিনছেন। ৭০টি গরু ছিল। কোরবানি উপলক্ষে এখন পর্যন্ত ৪০ বিক্রি হয়ে গেছে। আশা করছি, বাকিগুলোও বিক্রি হয়ে যাবে। কোনও হাটে নিতে হবে না।’
পুরান ঢাকার লালবাগ থেকে গরু কিনতে আসা ব্যবসায়ী মো. ওয়াহিদ উদ্দিন বলেন, ‘একসময় পুরান ঢাকার হাটে গেলে সাদা গরু পাওয়া যেতো। এখন পাওয়া যায় না। এজন্য এখান থেকে নিতে হয়। এই গরুর বিশেষত্ব হলো অন্যান্য গরুর মাংসের চেয়ে বেশি সুস্বাদু। এবার এখান থেকে দুটি গরু কিনেছি সাড়ে চার লাখ টাকায়। আরও কয়েকটি কিনবো। তবে আগের চেয়ে চাহিদা কমেছে। এজন্য দামও আগের মতো নেই।’
বর্তমানে দুই শতাধিক সাদা গরু আছে
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ছয় হাজার ২৭২ জন খামারি গরু লালন-পালন করছেন। এ বছর কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু আছে ৮১ হাজার ৮৭৫টি। এর মধ্যে দুই শতাধিক সাদা গরু। জেলায় কোরবানিতে চাহিদা আছে ৬৯ হাজার ৭৭০টির। হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকবে ১২ হাজার ১০৫টি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিরকাদিমে হাতেগোনা দুই-চার জন খামারি সাদা গরু লালন-পালন করেন। আশঙ্কাজনক হারে খামারির সংখ্যা কমে গেছে। আগে যেখানে প্রায় ঘরে ঘরে খামারি সাদা গরু লালন-পালন করতেন, এখন আগের অবস্থা নেই। আমরা খামারিদের উৎসাহিত করছি। বিনামূল্যে টিকা এবং চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। তবু খামারিরা আগ্রহ পাচ্ছেন না।’

