‘সন্ত্রাসী’ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা, শেষে রিকশাচালককে পিটিয়ে হত্যা
বাংলাদেশ

‘সন্ত্রাসী’ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা, শেষে রিকশাচালককে পিটিয়ে হত্যা

চাঁদাবাজি, মাদকের ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য গড়ে তোলেন ‘জিতু বাহিনী’। হয়েছেন একাধিক মামলার আসামি। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ১৪ বছর জেলও খেটেছেন। এরপরও জিতু ইসলামকে বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক করেছিল বিএনপি। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ‍ওঠেন। জেলাজুড়ে চালাতে থাকেন নানা অপকর্ম। শেষে স্কুলপড়ুয়া ১৪ বছরের কিশোরীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন ৪৩ বছরের জিতু। এতে রাজি না হওয়ায় কিশোরীর রিকশাচালক বাবাকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন।

গত শনিবার সন্ধ্যায় শহরের ফুলবাড়ী মধ্যপাড়া করতোয়া নদীর নয়াঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত অটোরিকশাচালকের নাম মো. শাকিল আহম্মেদ (৩২)। তার বাড়ি শহরের শিববাটি এলাকায়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা জিতু ইসলাম এবং তার সহযোগী মতিউর রহমানসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিতু জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক। এ ঘটনায় তাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। জিতু শহরের ফুলবাড়ি এলাকার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে। তবে তিনি শিববাটি শাহী মসজিদ লেন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। এলাকায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও নানা অপকর্ম করে বেড়াতেন।

পুলিশ, দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিতু ইসলাম হত্যাসহ চারটি মামলার আসামি। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় কারাভোগ করেছেন। আগে জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার লিটনের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। আগে থেকেই সন্ত্রাসী ও নানা অপরাধে জড়িত ছিলেন। এলাকায় বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও মাদকের ব্যবসা করেন। বালু ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জেরে ২০০৩ সালে প্রতিপক্ষ রবিউল ইসলামকে হত্যা করেন। এই মামলায় ১৪ বছরের সাজা হয়েছিল। বছর তিনেক আগে জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর ‘জিতু বাহিনী’ গড়ে তোলেন। সব সময় কয়েকজন সন্ত্রাসী ও ক্যাডার নিয়ে চলাফেরা করতেন। হত্যা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে একটি ডাকাতি ও দুটি মাদকের মামলা রয়েছে।

চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ১০১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এতে জিতু ইসলামকে সহ-সাধারণ সম্পাদক করা হয়। হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাকে এত বড় পদ দেওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীরা হতবাক হন। বড় পদ পেয়ে জিতু হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া। তখন থেকে কয়েকজন বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরা করতেন। কথায় কথায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, চাঁদা না পেলে তুলে নিয়ে মারপিট ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছিল নিত্যদিনের কাজ। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিতু ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি ও অর্থ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে আশ্রয় দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন।

শাকিলের মামা সিফাত হোসেন ও স্থানীয় এক অটোরিকশাচালক জানিয়েছেন, সন্ত্রাসী হওয়ায় ৪৩ বছর বয়সেও বিয়ে করতে পারেননি জিতু। এ অবস্থায় কয়েকদিন আগে শাকিলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তবে মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিতে রাজি ছিলেন না শাকিল। এ নিয়ে শাকিলের ওপর ক্ষুব্ধ হন জিতু। সেইসঙ্গে তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। এর জেরে গত শনিবার দুপুরে উভয়ের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে জিতুকে থাপ্পড় মারেন শাকিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জিতু ও তার বাহিনীর সদস্যরা শাকিলকে বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে কৌশলে পালিয়ে যান শাকিল। জিতু ও তার বাহিনীর হামলার ভয়ে ওই দিন বিকাল ৩টার দিকে বোনের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। বিষয়টি জেনে সন্ধ্যার আগে জিতুর নেতৃত্বে তার সহযোগী মতিউর রহমান, মোমিদুল, বিপ্লব, সুমনসহ ৩০-৩৫ জন ১৫-২০টি মোটরসাইকেলে ওই বাড়িতে যান। তারা মারধর না করার আশ্বাস দিয়ে শাকিলকে টেনেহিঁচড়ে বোনের বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যান। করতোয়া নদীর নয়াঘাট এলাকায় নিয়ে গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে আহত অবস্থায় ফেলে যান। পরে পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সন্ধ্যা ৬টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

এরই মধ্যে তাকে পিটিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। দুই মিনিট ২৫ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, জিতুর নেতৃত্বে তার সহযোগী মতিউরসহ বেশ কয়েকজন শাকিলকে গাছের ডাল দিয়ে পেটাচ্ছেন। এ সময় শাকিল প্রাণভিক্ষা চেয়ে বারবার আকুতি করছেন। এরপরও বেধড়ক পেটানো হয়। এই দৃশ্য তাদের আরেক সহযোগী মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে রাখেন। নিজের ও তার বাহিনীর প্রভাব অন্যদের দেখাতে পরে ওই ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

নয়াঘাট এলাকার এক বাসিন্দা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘শাকিলকে গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেই তারা থামেনি। দৃষ্টান্ত রাখার জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পুরো ঘটনার ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আশপাশের লোকজন ভয়ে এগিয়ে যায়নি। তবে দু’একজন এভাবে মারতে নিষেধ করেছেন। ঘটনায় জড়িত ছিলেন ৩০-৩৫ জন। তারা সবাই জিতু বাহিনীর সদস্য। দু’চার জনকে গ্রেফতার করলে এসব অপকর্ম থামবে না। অবিলম্বে সবাইকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’

এ ঘটনায় শাকিলের স্ত্রী মালেকা খাতুন রবিবার সকালে বগুড়া সদর থানায় জিতুকে প্রধান আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ১০ জনকে আসামি করে ২৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে জিতু ইসলাম (৪৩), তার সহযোগী একই এলাকার আবদুল আজিজের ছেলে মতিউর রহমান মতি (৩২) ও ফুলবাড়ি কারিগরপাড়ার কুতুব উদ্দিনের ছেলে শফিকুল হাসান বিপ্লবকে (৩৫) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওই দিন তাদের আদালতে হাজির করে সাত দিন করে রিমান্ড চাইলে পাঁচ দিন করে মঞ্জুর করেন আদালত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিববাটি শাহী মসজিদ লেন এলাকার দুজন বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, জিতু ও তার বাহিনীর অত্যাচারে ফুলবাড়ি, শিববাটিসহ আশপাশের এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। কথায় কথায় জিতু ও তার বাহিনীর সদস্যরা যে কাউকে নির্যাতন করতেন। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, মাদকের ব্যবসা করলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দলীয় পদ পেয়ে হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া। এলাকায় কেউ বাড়ি নির্মাণ করলে জিতুর নির্ধারিত দোকান থেকে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে হতো।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সরকার মুকুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই ঘটনার পর জিতু ইসলামকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে কেন্দ্রে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দলের নাম ভেঙে নানা অপকর্ম করেছেন বলে শুনছি এখন। এসব আগে জানা ছিল না আমাদের। তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অনুরোধ করেছি আমরা।’

নিহত শাকিলের স্ত্রী মালেকা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাকে অকালে বিধবা ও আমার সন্তানকে এতিম বানিয়ে দিয়েছে জিতু ও তার বাহিনী। ঘটনায় জড়িত অনেককে এখনও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। মাত্র তিন জনকে গ্রেফতার করেছে। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে স্বামী হত্যার বিচার চাই সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে। যাতে আর কোনও স্ত্রীকে এভাবে বিধবা হতে না হয়।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফুলবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) জোবায়েদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন সোমবার বিকাল পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে তিন জন জানিয়েছেন, তারা পরিকল্পিতভাবে শাকিলকে হত্যা করেননি। মারধরের কারণে মৃত্যু হয়েছে। এটি দুর্ঘটনা বলছেন তারা। রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই তারা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেবেন আশা করা যায়। ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তবে বাকি আসামিদের এখনও গ্রেফতার করা যায়নি।’

বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান বাসির বলেন, ‌‘জিতু ও তার সহযোগীরা শাকিলকে বাড়ি থেকে তুলে মারধরের পর মব তৈরি করে পুলিশে সোপর্দ করার চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এ ঘটনায় জিতু ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।’

Source link

Related posts

জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কৃষক পরিবার

News Desk

পরিকল্পনামন্ত্রীর মুঠোফোন ছিনতাইকারী শনাক্ত

News Desk

পানিবন্দি এলাকায় পৌঁছেনি পর্যাপ্ত ত্রাণ

News Desk

Leave a Comment