তিন সন্তানসহ ৩০ বছর বয়সী হারেছা বেগমকে ছেড়ে গিয়েছেন তার স্বামী। এ অবস্থায় সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে তিনি কাজ নেন কক্সবাজারের নাজিরার টেক শুঁটকি পল্লিতে। তবে সারাদিন কাজ করে তিনি পান মাত্র ২৫০-৩০০ টাকা। এ নিয়ে খুব কষ্টে ও টানাপোড়েনের মধ্যে দিন কাটে হারেছার।
শুধু হারেছা নন, তার মতো কক্সবাজার শুঁটকি পল্লিতে কাজ করেন প্রায় ১২ হাজার নারী শ্রমিক। তাদের প্রত্যেকের দৈনিক মজুরি ২০০-৩০০ টাকা। এ দিয়ে খুব কষ্টে চলে তাদের সংসার। অথচ শুঁটকি পল্লিতে নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে বেশি কাজ করেন।
হারেছা বেগম বলেন, ২০২০ সালের দিকে কক্সবাজারের মহেশখালী ঘোরকঘাটা এলাকায় স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জের ধরে ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর থেকে নানা জায়গায় বিচার চেয়ে ঘুরেছি। তবে কোনও বিচার পাইনি। পরে কক্সবাজার শহরে এসে কাজ নিয়েছি শুঁটকি পল্লিতে। সেই থেকে তিন শিশু সন্তান নিয়ে শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। পরিবারের খরচ যোগাতে বাধ্য হয়েই শুঁটকি মহালে দিনমজুরের কাজ করি। প্রতিদিন ভোর ৬টায় কাজে আসি, ফিরি সন্ধ্যা ৭টায়। দৈনিক ১১ ঘণ্টা কাজ শেষে মজুরি পাই ৩০০ টাকা। এই টাকায় আসলে এখন আর সংসার চলে না। অথচ একই জায়গায় একই কাজ করে আমার পুরুষ সহকর্মীরা দৈনিক মজুরি পান ৫০০ টাকা করে।
এমন বৈষম্যের চিত্র দেখা যায় পার্শ্ববর্তী মোহাম্মদ আলমের মাছ খোলায়। সেখানে কাজ করে ১৬ বছর বয়সী সাইমা। সে বলে, বাবা রফিক উল্লাহ এক বছর আগে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। অসুস্থ মা ও দুই ভাইবোনের সংসারের খরচ যোগাতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি। কিন্তু পাই মাত্র ২০০ টাকা। কিন্তু আমাদেরই সমান কাজ করে একজন পুরুষ পান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
বেতনে এমন বৈষম্য কেন? এমন প্রশ্নে তেমন কেউই কিছু বলতে চাননি। তবে এক নারী কর্মী বলেন, নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে এমন বেতন বৈষম্য শুরু থেকেই। এটাই এখানকার নিয়ম। এর বাইরে কেউ কথা বললে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পেট চালানোর জন্য তাই এই অন্যায় মেনে নিয়েই কাজ করছি।
নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের তথ্যমতে, কক্সবাজার নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের ৪৩৫টি মাছ খোলায় প্রায় ১২ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করেন। মজুরি হিসেবে এই রেইট নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শ্রমিকদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ৬০ ভাগ।
বেতন বৈষম্যের বিষয়ে মাছ খোলার মালিক জাফর আলম বলেন, সব জায়গাতে একই রেট। এছাড়া নাজিরারটেকে নারী শ্রমিক যেভাবে পাওয়া যায়, তেমনভাবে পুরুষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। আবার পুরুদের কাজ নারীদের চেয়ে এগিয়ে। তাই তাদের বাড়তি বেতন দেওয়া হয়। একই ধরনের কথা বলেন আরও কয়েকজন মাছ খোলার মালিক।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক উপকূলের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, নুনিয়াছটা, সিসিডিবি, পানিরকূপ পাড়াসহ মোট ২১টি গ্রাম নিয়ে দেশের বৃহৎ শুঁটকিমহালটি গড়ে উঠেছে। এসব গ্রামে বাস করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।
শুঁটকিমহাল নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’। তাদের সদস্যসংখ্যা এক হাজার ১১৭। সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ বলেন, বর্তমানে ছোট-বড় ৯৫০টি শুঁটকিমহালে কাজ করছেন ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ১২ হাজার। পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। তা ছাড়া পুরুষের মতো নারীরা ভারী কাজ করতে পারেন না। শারীরিকভাবেও তারা ফিট নন। তাই মজুরি তাদের কিছুটা কম।’
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, গত মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল। এবার শুঁটকির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। এর বাজারমূল্য ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীর অবদান উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।