গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার এমসি বাজারে যুবদল নেতার নেতৃত্বে প্রকাশ্যে রামদা নিয়ে মহড়া ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলার ঘটনায় উৎকণ্ঠা এবং আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এমন চাঁদাবাজির ঘটনা গত ২০ বছরের মধ্যে দেখেননি বলে জানিয়েছেন তারা। প্রত্যেক দোকান থেকে চাঁদা তোলার পরও বাজারে পুলিশের টহল এমনকি ব্যবসায়ীদের জানমালের নিরাপত্তা এখনও পুলিশ নিশ্চিত করেনি বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় রবিবার আতঙ্কের মধ্যে দোকান করেছেন তারা।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, যুবদল নেতার নেতৃত্বে প্রকাশ্যে মাথায় ও মুখে গামছা পেঁচিয়ে রামদা নিয়ে মহড়া এবং চাঁদা তোলার ঘটনায় চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির ঘটনায় ওই বাজারের ব্যবসায়ী হযরত আলী বাদী হয়ে শনিবার রাতে একটি মামলা করেন। মামলার পর রাতেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে একজনের কাছ থেকে একটি রামদা জব্দ করা হয়। তবে ঘটনার মূলহোতা যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। রবিবার বিকাল ৪টার দিকে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন মন্ডল এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন উপজেলার তেলিহাটী ইউনিয়নের মুলাইদ মধ্যপাড়া গ্রামের মৃত দুলাল উদ্দিনের ছেলে হাসেম (৩৯), আইনুদ্দিনের ছেলে আসাদুল ইসলাম (২৪), মৃত ছমির উদ্দিনের ছেলে সুমন মিয়া (২৮) এবং টেপিরবাড়ি গ্রামের দেওচালা এলাকার মো. মাইজ উদ্দিনের ছেলে হৃদয় হাসান রাকিব (২৬)।
পুলিশ জানায়, চাঁদাবাজির ঘটনায় যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান করে অজ্ঞাত ২০-২৫ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন এমসি বাজারের ব্যবসায়ী হযরত আলী। মামলায় বাদী বাজারের ব্যবসায়ীদের মারধর করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ করেন। গ্রেফতারকৃতদের রবিবার বিকালে কারাগারে পাঠানো হয়।
এর আগে শনিবার বিকালে দেশীয় অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে শ্রীপুরের এমসি বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের নূরুল ইসলাম নূরের ছেলে। চাঁদাবাজির ঘটনার পর ওই দিন সন্ধ্যায় তাকে দলের সব পদ থেকে বহিষ্কার করে যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি।
বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে এমসি বাজারে যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম পিন্টুর নেতৃত্বে মিছিল করা হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই ধারালো হাঁসুয়া, রামদা, ও লোহার রড উঁচিয়ে মহড়া দেন। অনেকের মুখে ও মাথায় লাল গামছা প্যাঁচানো ছিল। তারা এমসি বাজার ঘুরে মিছিল করেছেন। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রোড ডিভাইডারের ওপর দাঁড়িয়ে সমাবেশ করেছেন তারা। সমাবেশে হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে জাহাঙ্গীর আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘দোকানদার ভাইয়েরা আমি জেল থেকে এসে আপনাদের ঘোষণা দিয়েছিলাম, সবার সহযোগিতায় এমসি বাজার সুন্দরভাবে পরিচালনা করবো। কিন্তু বিএনপির দালাল চক্রের কারণে আমি এটি করতে পারিনি। আমার সব লোকজন নিয়ে আজ বাজারে এসেছি আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে। আপনাদের সহযোগিতা করতে। আজকের পর থেকে এই বাজারের সব টাকা তুলবো আমি। কে বাজার ডাকছে, কে ডাকে নাই; সেটা আমার জানার দরকার নাই। আমার নেতৃত্বে বাজার চলবে। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন এই বাজার আমার নেতৃত্বে চলবে। দোকানদার ভাইয়েরা আজকে থেকে টাকা দেওয়া শুরু করবেন। এখন থেকে আমার লোকজন টাকা তোলা শুরু করবে। কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে প্রতিহত করবো এবং তাকে অনেক খেসারত দিতে হবে। সবাইকে পরিষ্কারভাবে বলছি, কেউ বাধা দিতে আসবেন না। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন।’
আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা
এদিকে, সশস্ত্র অবস্থায় বাজার থেকে চাঁদা তোলার ঘটনায় এখনও জাহাঙ্গীর গ্রেফতার এবং অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা বলছেন, ওই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশকে একবারের জন্যও তারা এমসি বাজার ও আশপাশের এলাকায় টহল দিতে দেখেননি। যেকোনো সময় জাহাঙ্গীর ও তার অনুসারীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট করতে পারেন বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
বাজারের ফল ব্যবসায়ী লিটন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এই বাজারে ১৬ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছি। গতকাল ঘটনার সময়ে আমি দোকানে ছিলাম না, আমার ছেলে দোকোনে ছিল। তারা আমার ছেলের গলায় দা ধরে তার কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে গেছে। অথচ এখনও জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।’
চা বিক্রেতা কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘২১ বছর ধরে এই বাজারে ব্যবসা করছি। এর আগে কখনও কাউকে এভাবে চাঁদা তুলতে দেখিনি। যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর রামদা নিয়ে মিছিল করে আমাদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চাঁদা নিয়ে গেছে। এমনটি কখনও আমরা আশা করিনি। এভাবে চাঁদা তোলা আমরা ব্যবসায়ীরা মেনে নেবো না।’
কসমেটিকস ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেভাবে আমাদের গলায় রামদা ধরে চাঁদা নিয়ে গেছে যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর, সেটি তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্যই তার দলের কোনও নেতার প্রশ্রয়ে থেকে বেপরোয়া হয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। তাকে গ্রেফতার না করলে আমাদের আতঙ্ক কাটবে না।’
জুতা ব্যবসায়ী ফারুক মিয়ার দোকানের কর্মচারী আকাশ, হারেছের দোকানের কর্মচারী মিনহাজ জানিয়েছেন, ওই সময় আমাদের মালিক দোকানে ছিলেন না। হঠাৎ পাঁচ-ছয় জন ছেলে মাথায় ও মুখে গামছা পরে হাতে রামদা নিয়ে চাঁদা চায়। আমরা তাদের বলেছিলাম, মালিক দোকানে নেই। তখন রামদা দিয়ে আমাদের কুপিয়ে হত্যার হুমকি দিলে ক্যাশ থেকে তাদের টাকা বের করে দিয়েছি। বাজারের সব ব্যবসায়ী দিয়েছেন।
আরেক ব্যবসায়ী সালমান বলেন, ‘আমার কাছে টাকা চাইতে আসলে প্রথমে দিতে চাইনি। পরে তাদের সঙ্গে থাকা এক ছেলে আমার মোবাইল কেড়ে নেয়। এ সময় একজন দা দিয়ে কোপ দেওয়ার চেষ্টা করলে ৫০০ টাকা বের করে দিই। এরপর আমার মোবাইল ফেরত দিয়ে চলে যায় তারা।’
মুদি দোকানি মোর্শেদ আলম বলেন, ‘আমার কাছে চাঁদা চাইলে ভয়ে তাদের ১০০ টাকা দিয়েছিলাম। সামনে ঈদ। প্রত্যেক দোকানে লাখ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে। দিনদুপুরে রামদা হাতে চাঁদাবাজির ঘটনার পর থেকে আমরা আতঙ্কে আছি। অথচ বাজারে পুলিশের কোনও টহল কিংবা নিরাপত্তা আমার চোখে পড়েনি।’
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী নাহিদ এবং শ্যামল জানান, রামদা নিয়ে আমাদের কাছে চাঁদা চাইলে ভয়ে দিয়েছি। কিন্তু এভাবে কতদিন দেবো আমরা। এর আগে এভাবে কখনও অস্ত্রের মুখে চাঁদা নেয়নি কেউ। বাজারের সব ব্যবসায়ী আতঙ্কে আছেন। অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরকে এখনও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। এটি আতঙ্কের কারণ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন মন্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাতেই জাহাঙ্গীরের চার সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের রবিবার গাজীপুর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রধান আসামি জাহাঙ্গীরসহ তার অপর সহযোগীদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত আছে। বাজারে পুলিশের টহল জোরদার করা হবে।’
