রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি, কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি
বাংলাদেশ

রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি, কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি

ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে রাজশাহীতে পদ্মার পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি ঢুকে কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এখনও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতে পদ্মার তীরবর্তী নতুন নতুন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিন ধরে পদ্মার পানি বেড়ে চলছে। এতে পদ্মার তীরবর্তী নতুন নতুন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েকশ পরিবার। একই পরিস্থিতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিম্নাঞ্চলেও। জেলাটিতে পদ্মার পানি বিপদসীমার নিচে থাকলেও কোথাও কোথাও বন্যা দেখা দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রাজশাহী কার্যালয় সূত্র জানায়, রাজশাহীতে বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পদ্মা নদীর পানি। নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে, সঙ্গে চলছে নদীর ভাঙন। এই পরিস্থিতিতে সতর্কতা জারি করেছে পাউবো। গত রবিবার সকাল ৯টায় পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ১৩ মিটার। সোমবার সকাল ৯টায় ছিল ১৭ দশমিক ৩২ মিটার। মঙ্গলবার বেড়ে হয় ১৭ দশমিক ৪৩ মিটার। বুধবার তা বেড়ে হয়েছে ১৭ দশমিক ৪৯ মিটার। রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পানির বিপদসীমা ১৮ দশমিক শূন্য ৫ মিটার।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহী শহরের তালাইমারী, কাজলা, পঞ্চবটি, পাঠানপাড়া লালনশাহ মঞ্চ, শ্রীরামপুরসহ বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অনেকে বাড়ি ছেড়েছেন। সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে নগরের তালাইমারী, শ্রীরামপুর ও পঞ্চবটি এলাকায়। শহর থেকে দক্ষিণে চরখিদিরপুর, খানপুর ও বাঘার চক রাজাপুরের বেশিরভাগ অংশ ডুবে গেছে। এ ছাড়া নগরের শ্রীরামপুর এলাকায় অন্তত ৩০টি পরিবার নতুন করে পানিবন্দি হয়েছে। বুধবার অনেককে বাড়ি ছাড়তে দেখা যায়। এই এলাকার বাসিন্দা মো. শাহাবুল নৌকায় করে ডুবে যাওয়া বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আর থাকা যাচ্ছে না। সব ডুবে গেছে।’

অনেকে গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। শহর রক্ষা বাঁধে কথা হয় তাহাসীন আলীর সঙ্গে। তিনি ১৮টি গরু শহর রক্ষা বাঁধের নিচে বেঁধে রেখেছেন। তাহাসীন জানান, তাদের বাড়ি এখানেই। বাড়িতে বুকসমান পানি।

শহর রক্ষার জন্য রাজশাহী শহর অংশে টি-বাঁধ ও আই-বাঁধ নামে কয়েকটি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। এসব এলাকায় পদ্মার পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মাঝনদীর দিকে চলে যায়। এতে শহর অংশে পানির চাপ কম হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সতর্কতা হিসেবে পদ্মা নদীর আই বাঁধ ও টি-বাঁধ এলাকায় ভ্রমণের ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়।

পদ্মার পানির উচ্চতা পরিমাপক পাউবোর গেজ রিডার এনামুল হক জানান, বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় পদ্মার পানির উচ্চতা হয় ১৭ দশমিক ৪৯ মিটার। আরও বাড়তে পারে। এতে নিম্নাঞ্চল আরও প্লাবিত হবে। প্রতি বছরই পানি বাড়লে টি-বাঁধের ক্ষতির আশঙ্কায় সাধারণের সেখানে চলাচল বন্ধ করা হয়। এবারও বন্ধ করা হয়েছে।

নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানান, বর্ষার শুরু থেকেই পদ্মার পানি বাড়ছে। এখন বিপদসীমার কাছাকাছি এবং স্রোতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে পানির নিচে চলে যাচ্ছে বালুচর। সদর, গোদাগাড়ী, চারঘাট, বাঘার তীরবর্তী এলাকা ও কিছু চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বসতভিটা ও কৃষিজমি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজশাহীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, ‘ফারাক্কার সবগুলো কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় পদ্মায় পানি বেড়েছে। গত দুই তিন বছরের মধ্যে এবার পানির উচ্চতা অনেক বেশি। পানির পরিমাণও বেশি। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্ক রয়েছেন। জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য টি-বাঁধ এলাকায় দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’

আরিফুর রহমান জানান, রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মার বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫ মিটার। গত ২৪ জুলাই পানি বেড়ে ১৬ দশমিক ৩৫ মিটার পর্যন্ত পৌঁছে ছিল। এরপর কিছুটা কমে আবার ৭ আগস্ট ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। তারপর থেকে বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত আছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড সতর্ক অবস্থায় আছে। নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া, বাঁধ মজবুত করা ও জরুরি উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

রাজশাহীর বাঘায় পদ্মার চরে হাঁটুপানি মাড়িয়ে স্কুলে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বাঘা উপজেলার পদ্মার মধ্যে চকরাজাপুর হাইস্কুল। এই স্কুলটি ১৯৭৮ সালে স্থাপিত হয়েছে। নদী ভাঙনের কারণে ১৯৯৮ সালে, ২০১২ সালে ও ২০১৮ সালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে যে অবস্থানে আছে স্কুলটি। যেকোনও সময়ে পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এর মধ্যে এক সপ্তাহ থেকে পদ্মার পানি বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে।

পদ্মার তীরবর্তী নতুন নতুন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে

এ বিষয়ে চকরাজাপুর হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়া খাতুন জানান, এক সপ্তাহ থেকে পদ্মার পানি বাড়ছে। দুই দিনে স্কুলের মাঠ ডুবে গেছে। ক্লাস না করলে সমস্যায় পড়তে হবে। তাই দুর্যোগের মধ্যেও স্কুলে যাচ্ছি।

চকরাজাপুর হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘পদ্মার ভাঙনের মুখে আছে স্কুলটি। ভাঙন থেকে ৫ মিটার দূরে রয়েছে। স্কুলের মাঠ ও চারটি টিনের ঘর পদ্মায় চলে গেছে। যেকোনও সময় পাকা ভবন পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিত অনেক কম। দূরের শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে পারছে না। কাছাকাছি কিছু ছেলে-মেয়ে পানি মাড়িয়ে আসছে। কষ্ট করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকদেরও স্কুলে আসা দূরহ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আসতে হচ্ছে। স্কুলে আসতে গিয়ে অনেকের জামাকাপড় ভিজে গেলে ক্লাসে বসে থাকতে পারছে না। তারা স্কুলে এসে ছুটি নিয়ে চলে যাচ্ছে।’

প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার বলেন, ‘এই স্কুলে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৫৩৭ জন। শিক্ষক কর্মচারী রয়েছেন ১৯ জন। পদ্মা ভাঙতে ভাঙতে স্কুলের মাঠ নদীতে চলে গেছে। চার কক্ষের টিনের ঘর সরিয়ে নিয়েছি। স্কুলের ৩ কক্ষবিশিষ্ট পাকা ভবন ও টিনের আরও ৪ কক্ষ ঘর পদ্মার ভাঙন থেকে ৫ মিটার দূরে আছে। এর মধ্যে পানি এসে স্কুল মাঠ ডুবে গেছে। নিচু ক্লাস রুমে পানি উঠেছে। বিষয়টি প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।’

চকরাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনোয়ার বাবলু দেওয়ান বলেন, ‘ভাঙনের কারণে চকরাজাপুর, কালিদাসখালী, লক্ষ্মীনগর মৌজার চিহ্ন হারিয়ে গেছে। বর্তমানে এগুলোর স্থান বলতে কিছু নেই। সম্পূর্ণটা নদীগর্ভে চলে গেছে। তবে স্কুল ভবনটি স্থানান্তর না করলে ভাঙনে যেকোনও সময় নদীগর্ভে চলে যাবে। বর্তমানে স্কুলে পানি উঠায় সঠিকভাবে ক্লাস নিতে পারছেন না শিক্ষকরা। এ ছাড়া চরের শতাধিক বাড়িঘর ও শত শত বিঘা জমিতে রোপণ করা আমবাগান, কুলবাগান, পেয়ারাবাগান, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলি জমি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে।’

উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বুধবার পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা-চরখিদিরপুর, চরখানপুর ও চরতারানগরে নৌকায় করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের এ যৌথ উদ্যোগে প্রায় ২০০টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়।

এ বিষয়ে পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরাফাত আমান আজিজ বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কষ্ট লাঘবে বর্তমান সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। সেই অনুযায়ী নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা খবর পাওয়া মাত্রই জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছি। শুধু তাই নয়, বন্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্যও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।’

পদ্মার পানিতে চরাঞ্চলগুলোর বসতভিটা ও ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। চর খিদিরপুরের বাসিন্দা আফজাল হোসেন বুধবার ত্রাণের চালের বস্তা হাতে পেয়ে বলেন, ‘প্রতি বছর বর্ষার সময় নদীর পানি বেড়ে গেলে আমাদের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। কাজ-কাম বন্ধ হয়ে যায়। এই ত্রাণ দিয়ে কয়েকদিন যাবে।’

ত্রাণ নিতে আসা চরখানপুরের আরফা খাতুন বলেন, ‘বন্যা ও নদীভাঙনে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। ঘরের খাবারও ফুরিয়ে আসছিল, ঠিক এমন সময়ে চাল পেলাম।’

বুধবার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টের পানি পরিমাপ শেষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নকশাকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বুধবার এখানে পানি পরিমাপ করে ১২ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার এই পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ছিল ১২ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা ছিল ১২ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার।’

পানি পরিমাপক হারিফুন নাঈম ইবনে সালাম বলেন, ‘এই পয়েন্টে প্রতিদিন গড়ে পানির উচ্চতা বাড়ছে ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।’

Rajshahi Padma River Water News 13.08 (11)

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১৩ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। বর্তমানে বিপদসীমা থেকে মাত্র দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার পানি বাড়লে বিপদসীমা অতিক্রম করবে পদ্মার পানি।’

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল মমিন বলেন, ‘পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার পাকশী ও লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের ফসলি জমিতে পানি উঠতে শুরু করেছে। এতে ফসল ডুবে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা আছে।’

এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়েই বইছে। কিন্তু জেলার সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, ‘পদ্মার পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। উজানের ঢলের চাপও কমেছে। আশা করা যায়, দুই দিন পর থেকে পানি কমতে শুরু করবে। এখন পর্যন্ত এটাকে পুরোপুরি বন্যা পরিস্থিতি না বলে সাময়িক বন্যা পরিস্থিতি বলা যায়।’

 

Source link

Related posts

এক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ৩৬ হাজার গাছ

News Desk

‘বজ্রপাতে মানুষ মারা গেলেও বিএনপির নামে মামলা দিতে বলবে’

News Desk

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে প্রস্তুত কার্গো স্টেশন, অপেক্ষা ফ্লাইট চালুর

News Desk

Leave a Comment