যশোরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে থমথমে পরিস্থিতি, দোকানি গ্রেফতার
বাংলাদেশ

যশোরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে থমথমে পরিস্থিতি, দোকানি গ্রেফতার

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের জের ধরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বুধবার (২৬ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলেও ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করায় ক্যাম্পাসে পদচারণা ছিল কম। স্থানীয় বাজারের দোকানপাট বন্ধ আছে। উত্ত্যক্তের ঘটনায় অভিযুক্ত দোকান মালিক মুনায়েম হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। 

এর আগে মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন যশোর-চৌগাছা সড়কের আমবটতলা বাজার এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিন ঘণ্টা পর পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে ঘটনার পর বুধবার সকাল থেকে বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে দোকান বন্ধ রেখেছেন। তবে ক্যাম্পাস কিংবা বাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন না থাকলেও পুলিশের টহল অব্যাহত আছে।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সোমবার বিকালে এক নারী শিক্ষার্থী মোবাইল মেরামত করতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আমবটতলা বাজারের দোকানি মুনায়েম হোসেনের দোকানে যান। সেখানে মোবাইল থেকে সিমকার্ড খুলতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে দোকানি মুনায়েম শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে গিয়ে হাত ধরেন। এ সময় শিক্ষার্থীর সঙ্গে অশালীন কথাবার্তা বলেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানালে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় দোকানির। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীকে অশ্লীল কথা বলেন। সেখান থেকে ফিরে শিক্ষার্থী বিষয়টি তার সহপাঠীদের জানান। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দোকানিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে যান সহপাঠীরা। তখন তাদের সঙ্গেও বাগবিতণ্ডায় জড়ালে দোকানিকে মারধর করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর অন্যান্য দোকানি ও স্থানীয় লোকজন একত্র হয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। শুরু হয় দুই পক্ষের সংঘর্ষ।

একপর্যায়ে ব্যবসায়ীরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার জন্য এলাকাবাসীকে ডেকে আনেন। তখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে ক্যাম্পাস এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সাংবাদিকসহ আহত হন অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসের এক সাংবাদিকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এমন অবস্থাতে তিন ঘণ্টায়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে না আসায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বাড়ে। পরে উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টোরিয়াল টিমের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে উভয় পক্ষকে শান্ত করেন। রাত সাড়ে ৯টার পর সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে যান উপাচার্য, ট্রেজারারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, উত্ত্যক্তের বিষয়টি জানতে পেরে তারা দোকানদারের কাছে প্রশ্ন করতে গেলে বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজন তাদের ওপর হামলা চালান। শিক্ষার্থীরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পেছন থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে চৌগাছা-যশোর সড়কে টায়ার ও বেঞ্চ জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষকেও অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এখনও আতঙ্ক কাটেনি।

দেরিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। এজন্য উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মজিদ ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হোসাইন আল মামুনের পদত্যাগ দাবি রাতে প্রায় চার ঘণ্টা তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। রাত দেড়টার দিকে হামলায় জড়িতদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করেন শিক্ষার্থীরা।

হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা

বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের পদচারণা কম। পরীক্ষা ও ক্লাস বন্ধ থাকলেও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলেছে। আহতদের কয়েকজন ক্যাম্পাসের আর এম খান মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছেণ। কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে সংঘর্ষের ঘটনাস্থল আমবটতলা বাজার বুধবার হাটের দিন থাকলেও অধিকাংশ দোকান বন্ধ থাকতে দেখা গেছে। সড়কের ওপর এখন ইটপাটকেল পড়ে থাকতে দেখা যায়।

স্থানীয় চুড়ামনকাটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে একট্টা গ্রামবাসী। অনেক শিক্ষার্থী আমবটতলায় এসে চা খেয়ে টাকা দেন না। বাজারের এক দোকানদারকে মেরেছেন তারা। তার প্রতিবাদ করায় হামলা করেছে। ঘটনার পর যে দোকানদারের সঙ্গে বিরোধ ছিল তাকে আটক করেছে পুলিশ। এখন বাজারে একধরনের গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে।’ 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিন জন দোকানদার জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা করতে চান না বাজারের কোনও দোকানদার। কারণ শিক্ষার্থীরাই দোকানদারদের ক্রেতা। কিন্তু শিক্ষার্থীরা দুই দফা এক দোকানদারকে মারধর করেছেন। মুনায়েমের পক্ষে ক্ষমা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারপরও মারধর করায় দোকানদাররা ক্ষিপ্ত হয়ে যান। তা নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কয়েকজন দোকানদারও আহত হন। 

বাজারের দোকানপাট বন্ধ

এ ব্যাপারে যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের প্রক্টরিয়াল বডিসহ অনেক শিক্ষক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসতে দেরি করায় পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কিত ও আহত। তাই বুধবার ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। শনিবার থেকে নিয়মিত ক্লাস চলবে। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর এলাকাবাসীর হামলা; একদম নিন্দনীয়। আমরা বিষয়টি নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেবো। বাজার কমিটির সঙ্গে বসে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেই বিষয়ে আলোচনা করবো।’

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। একটি মামলায় অভিযুক্ত দোকানিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনও নিরপরাধ ব্যক্তিকে আটক করা হবে না। কাউকে হয়রানি করা হবে না। ঘটনাস্থলে পুলিশ টহল অব্যহত রেখেছে। আশা করা যায়, পরিস্থিতি শান্ত থাকবে।’

Source link

Related posts

মাওয়া প্রান্তে প্রস্তুতি শেষের দিকে 

News Desk

নারায়ণগঞ্জে পত্রিকা অফিসে হামলা: ৮ আসামির জামিন নামঞ্জুর

News Desk

আরো এক সপ্তাহ বাড়লো লকডাউন

News Desk

Leave a Comment