মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ভরসাস্থল হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত নাম দি নিউ লাইফ। বরিশালের এই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে গত ছয় বছরে সুস্থ জীবনে ফিরেছেন দেড় হাজার রোগী। সর্বাধুনিক এই কেন্দ্রে কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি এবং অন্যান্য মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
গত ছয় বছরের কার্যক্রমের তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি নগরের একটি রেস্তোরাঁয় গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য জানিয়েছেন কেন্দ্রের দায়িত্বশীলরা। প্রতিষ্ঠানটির আওতায় পরিচালিত কার্যক্রমের মধ্যে ৫০০ ব্যক্তির ওপর পরিচালিত জরিপ, দেড় হাজার রোগীর কেস স্টাডি ও তাদের চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবার, স্বজন ও অভিভাবকদের সঙ্গে ১০টি মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণকারী ৭০০ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার, চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের সুস্থতার হার, ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, মাদকাসক্তদের চিকিৎসার আওতায় আনার কোনও বিকল্প নেই। এখানে চিকিৎসা নিলে রোগীরা সুস্থ হন।
প্রতিষ্ঠানটির আবাসিক চিকিৎসক মুফতি আল মুহিত বলেন, ‘মাদকের ভয়াবহতা রোধে চিকিৎসা কার্যক্রম একটি অনন্য পদ্ধতি। এজন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করতে হবে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যক্তি সুস্থ হয়ে গেলে ও মাদকমুক্ত হলে, ওই ব্যক্তির দ্বারা মাদক বিস্তারের সুযোগ নেই। পাশাপাশি আসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার আওতায় আনতে পারলে পারিবারিক কলহ সামাজিক অপরাধ কমে আসবে।’
বরিশাল নগরের ১নং সিএনবি পুল এলাকায় অবস্থিত অত্যাধুনিক এই চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে গত ছয় বছরে মাদকাসক্তি ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরেছেন এক হাজার ৩৫০ জন ব্যক্তি। বর্তমানে কেন্দ্রটিতে ১১০ জন ব্যক্তি চিকিৎসাধীন আছেন। পৃথকভাবে স্থাপনকৃত নারী ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১০ নারী রোগী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক পরিতোষ কুমার কুন্ডু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দি নিউ লাইফ সরকার অনুমোদিত একটি আধুনিক ও মানসম্মত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। দেশের যেকোনো স্থানের নিরাময় কেন্দ্রের তুলনায় এটি আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসানির্ভর কেন্দ্র। একজন মাদকাসক্তকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সব ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি এখানে রয়েছে। ফলে সুস্থতার হারও বেশি। এখানে চিকিৎসা নিয়ে হাজারের বেশি রোগী সুস্থ হয়েছেন।’
দি নিউ লাইফ মাদকাসক্তি ও মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মর্তুজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত নার্স এবং স্টাফদের তত্ত্বাবধানে রোগীদের নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। ফলে কেন্দ্রটিতে চিকিৎসা নিতে আসা প্রত্যেক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তরুণ ও যুবসমাজকে মাদকের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করার জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা।’
কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা যায়, রোগীর জন্য পৃথক বিছানা, মানসম্মত খাবার, বিনোদন, চিকিৎসা সরঞ্জাম, সার্বক্ষণিক সচল ৬৪টি সিসি ক্যামেরা, বৃহৎ হলরুম ও সুসজ্জিত বাগান রয়েছে। সবগুলো রোগীদের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। সাইকিয়াট্রিস্ট তপন কুমার সাহা কেন্দ্রটিতে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। কাউন্সিলিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন সাইকোলজিস্ট তরুণ মিত্র। এ ছাড়া অভিজ্ঞ মেডিসিন (এমবিবিএস) চিকিৎসক, রেজিস্টার্ড নার্স, ধর্মীয় শিক্ষক ও শিক্ষিত স্টাফ, ক্লিনার, বাবুর্চি এবং আয়া রয়েছেন।
কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. ইমাম হোসেন বলেন, ‘আধুনিক ও সঠিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়ার ফলে নিউ লাইফে ভর্তি রোগীদের প্রত্যেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। মাদকাসক্ত ও মানসিকভাবে অসুস্থ জীবন থেকে তারা সুস্থ হয়ে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন। শুধু বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা ছাড়াও রাজধানী ঢাকা থেকেও এখানে রোগী এসে ভর্তি হচ্ছেন। আমাদের এখানে চিকিৎসা মান অনেক ভালো ও উন্নত।’
চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনও কোনও মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা করা হচ্ছে। এর ফলে রোগীরা প্রকৃত চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হয়ে সুস্থ হতে পারছেন না। কিন্তু দি নিউ লাইফ কেন্দ্রটিতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখানে ওষুধ প্রয়োগের পাশাপাশি কাউন্সেলিং, পারিবারিক কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি, শিক্ষামূলক ক্লাস সেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। ফলে সুস্থ হয়ে রোগীরা সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন।
কেন্দ্রের ধর্মীয় শিক্ষক হাফেজ মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘সেবামূলক মনোভাব নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান আমরা পরিচালনা করছি। ফলে স্বল্প খরচে আমরা যেকোনো ব্যক্তিকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। অভিভাবকদের আর্থিক বিষয়টি বিবেচনা করে ডোপ টেস্ট, চিকিৎসকদের ফি, ওষুধ প্রদান, মানসম্পন্ন থাকা-খাওয়াসহ সব ধরনের ব্যয়ের দায়িত্ব বহন করা হচ্ছে। রোগীদের নিয়ে স্বজনদের বাড়তি কোনও ধরনের চিন্তা করতে হয় না।’
কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মুফতি আল মাহিদ বলেন, ‘মাদকাসক্তি নির্মূলে নিউ লাইফ প্রতিষ্ঠানটি যুগোপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির যেকোনো ভালো কাজে আমরা সহযোগিতা করবো। সমাজের বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ কমিয়ে আনতে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিকল্প নেই। এজন্য আসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহায়তায় অভিভাবক, স্বজন এবং সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।’