ভারতের ফারাক্কা বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৬ কোটি মানুষ
বাংলাদেশ

ভারতের ফারাক্কা বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৬ কোটি মানুষ

পদ্মার উজানে ভারতের নির্মাণ করা ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের অন্তত ছয় কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে আছেন উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি এবং দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলের চার কোটি মানুষ। ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) রাজশাহীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

রাজশাহী মহানগরীর একটি রেস্তোরাঁয় এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির আহ্বায়ক ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। এ সময় ফারাক্কা লং মার্চের অংশগ্রহণকারী মাহমুদ জামাল কাদেরী উপস্থিত ছিলেন।

মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার প্রভাবে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টে পানি স্বল্পতার কারণে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে। এর ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে আসছে। বরেন্দ্র অঞ্চল, বিশেষ করে উচ্চ বরেন্দ্রের প্রায় শতভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে আছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‌‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ ষোল আনা সফল হয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফারাক্কা রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। দেশে জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি হয় এ ইস্যুকে ভিত্তি করে। ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে তৎকালীন ভারতীয় শাসকরা ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ উপযুক্ত পরিমাণ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল, যা সঠিকভাবেই কার্যকর ছিল। এ চুক্তি অনুযায়ী বছরের সব থেকে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কার প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। অপরদিকে ভারত পাবে ২০ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। কোনও কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে এলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লস।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭৭ সালে এ চুক্তির ফলে ভারত গঙ্গা নদীর আন্তর্জাতিক চরিত্রকে স্বীকার করে নেয়। ৫ বছর মেয়াদি চুক্তিটি জাতিসংঘে অভিনন্দিত হয়েছিল। এরপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক বসেছে। বাংলাদেশ চেয়েছে এই যৌথ কমিশনে নেপালকে সম্পৃক্ত করতে। কিন্তু ভারতীয় পক্ষের বৈরীতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবারই। ১৯৮২ সালে সেই ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি শেষ হলে বাংলাদেশ সেটি নবায়ন করতে চাইলেও ভারতের আপত্তির কারণে সম্ভব হয়নি। প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে চুক্তি নবায়ন না হয়ে একটি সমঝোতা স্মারকপত্র স্বাক্ষরিত হয়। এ সমঝোতায় ১৯৭৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী পানি বণ্টনের ব্যবস্থা বহাল থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে ৮০ ভাগ পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ক্লস বাদ দেওয়া হয়। এর ফলে গঙ্গার পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৭ সালে চুক্তি নিয়ে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে নদী কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করে যৌথ নদী কমিশন গঠনের। কিন্তু ১৯৮২ সালের সমঝোতা স্মারকে সেটিও বাদ দেওয়া হয়।’

যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলছে ও আতঙ্কিত করছে উল্লেখ করে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার একটি নিয়মিত ঘটনা। পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ শতাধিক নদ-নদী ক্রমান্বয়ে মৃত খালে রূপ নিচ্ছে। গঙ্গা একটি মরা গাঙের রূপ নিয়েছে। গঙ্গার বুক চিরে চলাচল করছে বালুবাহী ট্রাক, গরু-মহিষের গাড়ি। বিগত ৪০ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় গঙ্গার আয়তন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। পানির প্রবাহ কম থাকায় তলদেশ ক্রমান্বয়ে ভরাট হচ্ছে। জলজ প্রাণী, বিশেষ করে কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গঙ্গার ডলফিন ও ঘড়িয়াল আর দেখা যায় না। আগের মতো পদ্মায় ইলিশের ঝাঁক আর আসে না।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশের গঙ্গায় আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। দক্ষিণের সুন্দরবনে মিঠাপানির সরবরাহ কমেছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারিতে গঙ্গায় পানির প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারিতে পানির প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গঙ্গায় পানির প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক। যদিও সে বছর গড় বৃষ্টির পরিমাণ ছিল পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কম। 

সংবাদ সম্মেলনে ফারাক্কার সমস্যা উত্তরণে কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হয়। মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার সমস্যার সমাধানে করণীয় বিষয়ে দ্রুতই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার সঙ্গে বসবেন।

Source link

Related posts

গরুর সঙ্গে ছাগল ফ্রি

News Desk

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার

News Desk

খুলনায় সাংবাদিক মোস্তফা কামাল করোনায় মারা গেলেন

News Desk

Leave a Comment