হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের পর দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ‘জীবন মহল’ বিনোদন পার্ক ও রিসোর্টটি এখন ধ্বংসস্তূপ। রিসোর্টজুড়ে রয়েছে ক্ষতচিহ্ন। ঘটনার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও রিসোর্টে কর্মরতদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে ভাঙাচোরা কোনও কিছুই সরানো হয়নি। এখনও হয়নি মামলা। ফলে হামলায় জড়িত কাউকে আটকও করা হয়নি।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের বেশিরভাগই ছিলেন বাইরের এলাকার লোকজন। হাতেগোনা স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ছিলেন। বাকিরা অন্যত্র থেকে এসেছেন।
জীবন মহল বিনোদন পার্কটি বিরল উপজেলার কাঞ্চন মোড় এলাকায় প্রায় দেড় যুগ আগে গড়ে তোলা হয়। এটির মালিক আনোয়ার হোসেন ওরফে জীবন চৌধুরী। তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এর আগে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী করা হয়েছিল। জীবন চৌধুরী একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সুরকার ও গীতিকার। তিনি মেডিটেশন নিয়ে পিএইচডি করেছেন। রিসোর্টের ভেতরে তার মেডিটেশন সেন্টার আছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী পার্কটিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এক সংবাদকর্মীসহ অন্তত ১২ জন আহত হন। ভাঙচুর করা হয়েছে দুটি মাইক্রোবাস ও পাঁচ সংবাদকর্মীর মোটরসাইকেল। পরে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এর আগে ১৭ আগস্ট ওই পার্কে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালায় জেলা প্রশাসন। অভিযানে দুজন নারী, পাঁচ জন পুরুষসহ সাত জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং পার্কের মালিক আনোয়ার হোসেনকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা জানা গেছে, স্থানীয় লোকজন পার্কে অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলার অভিযোগ করে আসছিলেন। আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের’ প্রতিবাদে ওই দিন বিকালে সেখানে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তার লোকজন। অপরদিকে আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতারের দাবিতে একই সময়ে সেখানে ‘তৌহিদি জনতার’ ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেন স্থানীয় লোকজন।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই দিন বেলা আড়াইটার দিকে পার্কের প্রধান ফটকের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু করেন আনোয়ার হোসেনের সমর্থকরা। বিকাল ৩টার দিকে কয়েক শ লোক বিভিন্ন দিক থেকে ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় উভয় পক্ষ লাঠিসোঁটা নিয়ে পরস্পরের ওপর হামলা করে। এ সুযোগে পার্কের ভেতরে ঢুকে মালামাল লুটপাট করেন কিছু লোক। একপর্যায়ে ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ইটপাটকেলের আঘাতে এক সাংবাদিকসহ অন্তত ১২ জন আহত হন। পরে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরপর আনোয়ার হোসেনের গ্রেফতারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন লোকজন। প্রশাসনের আশ্বাসে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে অবরোধ তুলে নেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফরক্কাবাদ ইউনিয়নের বিরল-দিনাজপুর সড়কের পাশেই জীবন মহল পার্ক। যার সামনে রয়েছে বাজার। সেখানে শতাধিক দোকান আছে। বাজারের চার জন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ওই দিনের ঘটনার পর থেকে পার্কটিতে শুধুমাত্র সাংবাদিক ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়া জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ করেছে প্রশাসন। ফলে যেখানে সবসময়ই কোলাহল লেগেই থাকতো, সেটি এখন নীরব-নিস্তব্ধ।
পার্কটিতে ঢুকতেই দেখা যায় প্রধান ফটক ভাঙা। ভাঙাচোরা জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভেতরে দেখা গেলো, শিশুদের খেলনার উপকরণ ও বিনোদনের সরঞ্জাম ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্যও ভেঙে পড়ে আছে। চারদিকে জিনিসপত্র ও পোড়া প্লাস্টিকের চেয়ার। ভেতরে মেডিটেশন সেন্টারে অগ্নিসংযোগের ক্ষত। ধর্মীয় ও চিকিৎসার অসংখ্য বই পুড়ে ছাই। সৌন্দর্যবর্ধক গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ভাঙা অবস্থায় আছে দুটি মাইক্রোবাস ও পাঁচটি মোটরসাইকেল। টেবিলগুলো ভেঙে তছনছ। টিকিট কাউন্টারও ভাঙচুর করা হয়েছে। বিভিন্ন কক্ষের দরজা-জানালা ও আসবাবপত্র ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ভেতরে ছিল দরিদ্রদের জন্য বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার কার্যালয় ‘জীবন উন্নয়ন সংস্থা’। সেটিও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। সবমিলিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।
পার্কের দুজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন কক্ষের জিনিসপত্র, খেলনা, সিসিটিভি ক্যামেরা, ১৫টি টেলিভিশন এমনকি ফ্যানগুলো লুট করা হয়েছে। ভাঙাচোরা জিনিসপত্র ছাড়া সবই নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।
এখনও আতঙ্কের মধ্যে আছেন বলে জানালেন পার্কের তত্ত্বাবধায়ক মজিবুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসতেন জীবন মহলে। শিশুদের বিচরণে মুখরিত থাকতো। ১৭ আগস্টের ঘটনার পর ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ১৮ আগস্ট ‘তৌহিদি জনতার’ ব্যানারে ৪০-৫০ জন বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এখানে এসে প্রতিবাদ জানান। তাদের বিক্ষোভের প্রতিবাদে এলাকার মানুষজন, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা গত বৃহস্পতিবার পার্কের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেন। অপরদিকে ‘তৌহিদি জনতাকে’ জড়ো হতে ঘোষণা দেয় একটি পক্ষ। আশপাশের উপজেলায় মাইকিং করা হয়। আমরা বিষয়টি পুলিশ ও প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম। তারপরও বিকাল ৩টার দিকে চার হাজারের মতো লোকজন জড়ো হয়ে পার্কে হামলা চালান। তারা প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে প্রথমে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। সব সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে ফেলেন। একপক্ষ জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন, আরেক পক্ষ অগ্নিসংযোগ করেন। পাশাপাশি কিছু ব্যক্তি লুটপাট চালান। তাদের হামলায় গুরুতর আহত হন পার্কের কর্মচারী মঞ্জুরুল আলম ও মো. মিজান। এর মধ্যে মঞ্জুরুলকে ঢাকায় ও মিজানকে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে এখানে কর্মরতরা একপ্রকার আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন।’
পার্কের ম্যানেজার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘পার্কের ওপর শতাধিক কর্মচারীর পরিবার নির্ভরশীল। ভেতরে ও বাইরে দুই শতাধিক দোকানে বেচাকেনা হতো দর্শনার্থীদের কাছে। এমন হামলার পর আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। সেদিন জীবন বাঁচানো-ই কঠিন ছিল। এখনও বেঁচে আছি এটাই অনেক। আর কিছুই বলার নেই।’
পার্কের বাইরের চা-দোকানি আব্দুল হালিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পার্কটি ঘিরেই ছিল আমাদের জীবন-জীবিকা। একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে তৌহিদি জনতার নামে হামলা চালিয়েছে। যেকোনো কিছুর প্রতিবাদ হতেই পারে। তাই বলে এভাবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট কোনোভাবেই মানা যায় না। বিনোদনকেন্দ্রটি আর চালু না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অন্তত দুই শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা।’
আনোয়ার হোসেন ওরফে জীবন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০০৪ সালে পৈতৃক ৬ একর জমির ওপর বিনোদনকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালে এটির উদ্বোধন করা হয়। এখানে সব ধরনের বৈধ কার্যক্রম চালানো হতো। হামলার আগে বিভিন্ন অপপ্রচার ছড়ানো হয়েছিল। যাতে মানুষজন ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু এলাকার মানুষজন আগে থেকেই এখানের কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন। যারা ভাঙচুর করেছেন তাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। জীবন মহল কোনও দরগাহ কিংবা মাজার না। এখানে লাইফ শাইনিং মেথড নিয়ে কাজ করা হতো। আমি ২৫ বছর ধরে মানবসেবা করছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবো। যেহেতু আমার জনপ্রিয়তা আছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হামলা চালানো হয়েছে। হামলাকারীরা এলাকার ছিল না। সবাই অপরিচিত ও বাইরে থেকে আসা। হামলায় প্রায় চার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
উপজেলা বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোজাম্মেল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জীবন চৌধুরী অনেক আগে থেকেই এলাকার মানুষের উন্নয়নে কাজ করছেন। তার বিনোদনকেন্দ্রের মাধ্যমে অনেকের সংসার চলতো। এভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে শেষ করে দেওয়া ঠিক হয়নি।’
দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মারুফাত হুসাইন বলেন, ‘সম্প্রতি সেখানে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে প্রশাসন অভিযান চালিয়েছে। মামলা দিয়েছে, জরিমানাও করেছে। পরে স্থানীয় লোকজন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেন। তারা কোনও ধরনের ঝামেলায় না জড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু জীবন চৌধুরী বাইরে থেকে লোক এনে তাদের ওপর ঢিল ছুড়েছেন। তখন তারাও আক্রমণ করেছেন। কোনও পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা মামলা করতে চাইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ঘটনায় কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুস সবুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় কোনও পক্ষই থানায় অভিযোগ দেয়নি। ফলে মামলা হয়নি। এ ঘটনায় কাউকে আটকও করা হয়নি।’