নুরাল পাগলার দরবারে হামলায় নিহতের বাড়িতে আহাজারি, এখনও মামলা করেনি পরিবার
বাংলাদেশ

নুরাল পাগলার দরবারে হামলায় নিহতের বাড়িতে আহাজারি, এখনও মামলা করেনি পরিবার

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত রাসেল মোল্লার (২৮) বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তার মৃত্যুতে আহাজারি করছেন স্বজনরা। 

রাসেল মোল্লা গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ান মোল্লা পাড়ার মো. আমজাদ মোল্লার ছেলে। তাদের বাড়িতেই ছিল নুরাল পাগলার দরবার। তিনি নুরাল পাগলার ভক্ত এবং মাঝেমধ্যে দরবারের খাদেম হিসেবে কাজ করতেন। পরিবারে দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন। স্ত্রী ও এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। মোস্তফা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাভার্ডভ্যান চালক ছিলেন। এর আগে শুক্রবার জুমার নামাজের পর সংঘর্ষে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়। 

শনিবার বিকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, জুড়ান মোল্লা পাড়ায় দরবারের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দরবারের ভেতর একটি তিনতলা এবং একটি দুইতলা ভবন। উৎসুক জনতা দেখতে আসছেন। ঘরের ভেতরে স্বজনদের কাঁদতে দেখা যায়। বাইরে লাশ দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছেন প্রতিবেশী ও স্বজনরা।

বাবা আমজাদ মোল্লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা পারিবারিকভাবে নুরাল পাগলার ভক্ত। রাসেল শুক্রবার সকাল থেকে বাড়িতেই ছিল। জুমার নামাজের পর বিক্ষুব্ধ মানুষজনকে মিছিল নিয়ে আসতে দেখে দরবার শরিফের গেটে অবস্থান নেয়। ভেতর থেকে গেট আটকে রাখে। বিক্ষুব্ধ লোকজন ধাক্কাধাক্কি করলেও গেটের দরজা খোলেনি। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়ির গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে রাসেলকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করেন। এরপর দরবার শরিফে হামলা-ভাঙচুরের পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করেন। ওদিকে রাসেলের অবস্থা গুরুতর দেখে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন। সেখানে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়। আমি ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।’ 

মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। দাফনের পর পরিবারের সবাই মিলে আলোচনা করে মামলার সিদ্ধান্ত নেবো।’

রাসেলের চাচা রাজ্জাক সরদার বলেন, ‘বিকাল ৫টার দিকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে রাসেলের লাশ বাড়িতে আনা হয়। সন্ধ্যা ৭টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।’

গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শরিফ ইসলাম জানান, গতকাল দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়ে ২২ জন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছিলেন। এর মধ্যে ১৯ জনকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে পথিমধ্যে রাসেল মারা যান। পরে বাকি তিন জনও নিরাপত্তার স্বার্থে স্বেচ্ছায় ওই হাসপাতালে চলে যান। আমাদের এখানে আহত কেউ নেই। 

এদিকে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নুরাল পাগলার দরবার এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দরবারের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ধ্বংসস্তূপ। মাঝেমধ্যে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখা যাচ্ছে। একনজর দেখতে ভিড় করছে উৎসুক জনতা।

নিহত রাসেল মোল্লার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দফায় দফায় নুরাল পাগলার দরবারে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা শরিয়ত পরিপন্থিভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেন। উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোকের এ হামলায় ১০ জন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। পুলিশের দুটি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। 

পুলিশ জানায়, পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় গোয়ালন্দ ঘাট থানায় মামলা হয়েছে। শুক্রবার রাতে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিবুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশের করা মামলায় শনিবার বিকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। দরবারে হামলা ও একজনের মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও অভিযোগ দেওয়া হয়নি।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে অনেক বছর আগে দরবার শরিফ গড়ে তোলেন নুরাল পাগলা। গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। ওই দিন রাতে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় আস্তানায় তার লাশ দাফন করেন ভক্তরা। এরপর বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কবর সমতল করাসহ কয়েকটি দাবি জানায় স্থানীয় আলেম সমাজ।

বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি ও নুরাল পাগলার পরিবারের সদস্যদের কয়েক দফায় বৈঠক হয়। তবে কবর নিচু না করায় দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয় ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। তারা বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতলসহ বিভিন্ন দাবি জানায়। অন্যথায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয়।

শুক্রবার নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার জুমার নামাজের পর আনসার ক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। বেলা ২টার পর থেকে আনসার ক্লাবে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জড়ো হতে থাকেন শত শত লোক। বেলা আড়াইটার দিকে হাতুড়ি, শাবল ও লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল লোক মিছিল নিয়ে আসে। এ সময় আয়োজকদের পক্ষ থেকে লাঠিসোঁটা, হাতুড়ি মঞ্চে জমা দিতে বলা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে মঞ্চে বক্তব্য চলাকালে কিছু লোক পুলিশের ওপর হামলা করে দুটি গাড়ি এবং ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশের ছয় সদস্য আহত হন।

বিকাল ৩টার দিকে মঞ্চ থেকে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, সদস্যসচিব বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী খান সবাইকে সমাবেশে থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু উত্তেজিত লোকজন মিছিল নিয়ে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা করেন। ভেতর থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন নুরাল পাগলার ভক্তরা। এ সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। এ সময় কিছু লোক দরবারের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেন এবং মালামাল লুটপাট করেন। একপর্যায়ে বিকাল ৫টার দিকে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে গোয়ালন্দ পদ্মার মোড়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ওপর নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

Source link

Related posts

সেই বিদ্যালয়ে হিজাব পরে আসতে বাধা নেই

News Desk

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণ

News Desk

রংপুরে আ.লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক আহত

News Desk

Leave a Comment