দেশে-বিদেশে দক্ষ জনশক্তি গড়তে কাজ করছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিকেটিটিসি)। প্রায় ৪১টি ট্রেড কোর্সে স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে যেমন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বেকার যুবকরা, তেমনি প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশেও দক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বিকেটিটিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০২২ সালে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন ১৭০ জন। তাদের মধ্যে ১৩৫ জন পুরুষ এবং ৩৫ জন নারী। একই বছর দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় চাকরির সুযোগ পেয়েছেন ২২৪ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২১২ জন এবং নারী ১২ জন। অপরদিকে বিদেশে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন ৬২ জন, তাদের মধ্যে পুরুষ ৫৭ জন এবং নারী পাঁচ জন। ২০২৩ সালে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন ৩২৯ জন। তাদের মধ্যে ২৫০ জন পুরুষ এবং ৭৯ জন নারী। একই বছর দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় চাকরির সুযোগ পেয়েছেন ৫৩২ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৪৯৫ জন এবং নারী ৩৭ জন। অপরদিকে বিদেশে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন ১৬৮ জন, তাদের মধ্যে পুরুষ ১৫৭ জন এবং নারী ১১ জন। ২০২৪ সালে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন ২৫১ জন। তাদের মধ্যে ১৯১ জন পুরুষ এবং ৬০ জন নারী। একই বছর দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় চাকরি পেয়েছেন ৩৬৯ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৩৪৪ জন এবং নারী ২৫ জন। ওই বছর বিদেশে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন ১৫২ জন, তাদের মধ্যে পুরুষ ১৪০ জন এবং নারী ১২ জন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ইন্সট্রাক্টর ও সেকশন ইনচার্জ (প্রি-ডিপার্চার) সৈয়দ আবু কাউছার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দক্ষ জনশক্তি গড়তে এই প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। যারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, তারা দেশে যেমন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনি দেশের বাইরে বিদেশেও দক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘১১টি নিয়মিত কোর্সে ভর্তির জন্য ২৭ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রতিটি কোর্সে ৩০ জন করে মোট ৩৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। অথচ ভর্তি পরীক্ষায় ১১টি কোর্সে এক হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। একইভাবে চার মাস মেয়াদী ড্রাইভিং কোর্সের জন্য ৮০ জন ভর্তি করানো হবে। ইতিমধ্যে ৫৮০ জন ফরম সংগ্রহ করেছেন। রবিবার ড্রাইভিং কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীণে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চট্টগ্রামের যুব ও যুব নারীদের দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতার প্রশিক্ষণ প্রদানে কাজ করছে। এখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কোর্সের মধ্যে রয়েছে- মোটরগাড়ি যন্ত্রবিদ্যা, বৈদ্যুতিক ইনস্টলেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ, আর.এ.সি, টেইলারিং ও পোশাক তৈরি, ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার অপারেশনস, এম.এস.পি, কার্পেন্ট্রি, অটোক্যাড ও ব্লক বাটিক। এ ছাড়া বিদেশ যাত্রীদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ কোর্স চালু রয়েছে প্রতিষ্ঠানে।
বিকেটিটিসির ইনস্ট্রাক্টর ও সেকশন ইনচার্জ (ওয়েল্ডিং) মো. ইমরান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানটি শিল্প এলাকার ভেতরে। এখানে আশপাশে অনেকগুলো শিল্পকারখানা আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের প্রশিক্ষণার্থীদের যথেষ্ট চাহিদা আছে। এসব প্রতিষ্ঠান আগে থেকে আমাদের চাহিদাপত্র দিয়ে থাকে। সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ শেষে তারা কাজে যোগদান করেন। যেহেতু তারা কাজ জানে সেজন্য তারা ভালো বেতন পেয়ে থাকেন। শুধু দেশেই নয়, আমাদের এখান থেকে যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন দেশের বাইরেও তাদের যথেষ্ট চাহিদা আছে।’
তিনি বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে তিন এবং চার মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স আছে। এর মধ্যে তিন মাস মেয়াদী কোর্সগুলো সরাসরি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়। চার মাস মেয়াদী কোর্সগুলো এডিবি এবং বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে হয়ে থাকে। এসব প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে কোনও ধরনের ফি নেওয়া হয় না। বরং প্রশিক্ষণার্থীদের দৈনিক ১৫০ টাকা করে টিফিন ও যাতায়াতের খরচ দেওয়া হয়।’
বিকেটিটিসির ইন্সট্রাক্টর (কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স) ফোরকান আহামদ বলেন, ‘আমি বর্তমানে কম্পিউটার অপারেশনস কোর্সে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছি। প্রতি ব্যাচে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর নতুন একটি ব্যাচে শিক্ষার্থী ভর্তির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাড়ে ৩০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। আগামী ৫ অক্টোবর থেকে এ ব্যাচে ক্লাস শুরু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন মাসের কম্পিউটার অপারেশনস কোর্সে ৭২ দিনের মতো দৈনিক ৪ ঘণ্টা করে ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। ৮০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে। তা না হলে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করা যায় না। তবে আমরা ক্লাস নিলেও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।’
বিকেটিটিসির সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর ও সেকশন ইনচার্জ (ব্লক বাটিক অ্যান্ড স্ক্রিন প্রিন্টিং) শিখা আচার্য্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক নারীই আজ স্বাবলম্বী। এই কোর্সে দৈনিক ২৪ জন করে প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে ৪-৫ জন পুরুষ হলেও বাকিরা নারী প্রশিক্ষণার্থী। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক নারী নিজেরাই প্রতিষ্ঠান করেছেন। আবার অনেকে চাকরি করছেন।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী পলাশ কুমার বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ-কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (বিকেটিটিসি) দক্ষ-প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন অনেকে। চট্টগ্রামের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষিতদের কাজে নিতে আগ্রহী। এসব প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে চাহিদা দিয়ে থাকে। যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসব শিল্পকারখানায় চাকরিতে যায় তারা ভালো বেতন পান।’
বিকেটিটিসি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ১৯৬২ সালে ১১ দশমিক ৩ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এটির নাম ছিল স্টাফ অ্যান্ড ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার (এসভিটিসি)। ওই সময় এটি সরাসরি শ্রম মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতো। সে সময় প্রশিক্ষণার্থীদের তিন ও ছয় মাসের কোর্স করানো হতো। ১৯৭৬ সালে সরকার এটির দায়িত্ব জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কাছে হস্তান্তর করে। নামকরণ করা হয় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)। বিভিন্ন সময় এর উন্নয়নে আইএলও, জাইকা, জেওসিভি ও ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা যুক্ত হয়। ২০০৫ সালে টিটিসিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে যুক্ত হয় কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কোইকা)। তারা এই কেন্দ্রটিকে আধুনিকায়ন করে এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ সুবিধাসম্পন্ন করে তোলে। নতুন নাম রাখা হয় বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিকেটিটিসি)। এর লক্ষ্য নতুন দক্ষতা উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। যাতে আগামী দিনগুলোতেও এই প্রতিষ্ঠান কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারে।