কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে যশোরের ‘সবজি জোন’ খ্যাত অঞ্চলের মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ, আমনের বীজতলা। ধান-সবজির ক্ষেতে পানি জমে যাওয়ায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, বর্ষায় আক্রান্ত ফসলি ক্ষেতের পরিমাণ তিন হাজার ১৯১ হেক্টর।
এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর প্রথম দিন থেকেই যশোরে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। কিছু দিন বিরতি দিয়ে আষাঢ় মাসজুড়েই বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে শেষের কয়েকদিনের বৃষ্টিপাত ছিল প্রবল।
যশোর বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিস সর্বশেষ তিন দিনের বৃষ্টিপাতের যে তথ্য দিয়েছে তাতে সবচেয়ে বেশি ১৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে সোমবার (১৪ জুলাই)। এ ছাড়া রবিবার (১৩ জুলাই) ৬৭, মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ১৯, বুধবার (১৬ জুলাই) বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় ২২ মিলিমিটার।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার লাগাতার বৃষ্টিতে শাক-সবজি, রোপা আউশ, রোপা আমনের বীজতলা, রোপা আমন, পাট ও মরিচের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
দেশে সবজি উৎপাদনের সবচেয়ে বড় জোন যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি, হৈবতপুর, কাশিমপুর ইউনিয়ন, চৌগাছা উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ সব থেকে বেশি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলায় চলতি মৌসুমে ৬০ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে ধান, সবজিসহ নানা ফসলের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রোপা আউশ ১৫ হাজার ৫১০ হেক্টর, রোপা আমন ৬৬৫ হেক্টর, রোপা আমনের বীজতলা ৬ হাজার ৯৪৫ হেক্টর, পাট ২৪ হাজার ৩৪০ হেক্টর, মরিচ ৪৬০ হেক্টর ও শাকসবজি ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি।
কয়েকদিনের প্রবল বৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ২৪৫ হেক্টর জমির রোপা আউশ, ৫০ হেক্টর জমির রোপা আমন, ৫৯০ হেক্টর জমির রোপা আমনের বীজতলা, ৬২৫ হেক্টর জমির পাট, ১২০ হেক্টর জমির মরিচ ও ৫৬১ হেক্টর জমির শাকসবজি।
যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি, হৈবতপুর ও কাশিমপুর ইউনিয়নের মাঠের পর মাঠে নানা ধরনের সবজি চাষ করেছিলেন কৃষক। এসব সবজির মধ্যে রয়েছে পুঁইশাক, বরবটি, পটল, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, কচুরমুখী। অনেকে আগাম পাতাকপিরও চাষ করেছেন।
চুড়ামনকাটির আব্দুলপুরে দেশের বৃহত্তম সবজি বীজ উৎপাদন জোনে এবারও আগাম পাতাকপিসহ অন্য সবজির চারা রোপণ করেছিলেন কৃষকরা।
এই গ্রামের কৃষক আমিনউদ্দিন জানান, তিনি মূলত সবজির চারা উৎপাদন করেন। এবার বৃষ্টিতে বেগুন, ফুলকপি, পাতাকপিসহ তার সবজির চারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টিপাত এমন চললে আগামী শীত মৌসুমের আগেই সবজির বাজারে তার বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে অধিকাংশ সবজি ও সবজি চারার ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পানির নিচে চলে গেছে রোপা আমন, রোপা আউশ ও রোপা আমনের বীজতলাও। ফলে কৃষকরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে রয়েছেন। বিশেষ করে সবজি পাওয়ার আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছেন তারা।
যশোর সদরের হৈবতপুর গ্রামের সবজি চাষি আব্দুল আলিম বলেন, প্রায় ৫ বিঘা জমিতে বেগুন, শিম, পটল, লাউ, মুলার চাষ করেছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আমার ক্ষেতের প্রায় সব সবজি বিনষ্ট হয়ে গেছে। পটল, মুলা, লাউয়ের মতো বেগুন গাছ মরে গেছে। এতে প্রায় দুই লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বীজতলা একটু উঁচু জমিতে বিধায় এখনও টিকে আছে। বৃষ্টি শেষ হলে দেখি কী করা যায়- মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, হৈবতপুর গ্রামের আশরাফ, বাদশাহ, আল আমিনসহ অনেকেই সবজি চাষ করেছিলেন। আমার মতো তারাও ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
এদিকে, কৃষকরা আশঙ্কা করছেন, রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বেশিরভাগ সবজি মাঠেই মারা যাবে। কিছু অবশিষ্ট থাকলেও ফলন ভালো হবে না। এমন পরিস্থিতিতে কৃষকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে।
সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ও দেয়াড়া ইউনিয়ন এবং চৌগাছা উপজেলার ফুলসারা, পাশাপোল ও সিংহঝুলি ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এড়োলের বিলে এবারও হাজার হাজার বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছিলেন কৃষক। তার সবই বর্ষার পানিতে তলিয়ে গেছে।
চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ও ফুলসারা ইউনিয়নের মধ্যবর্তী বলিদাপাড়া বিল বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। গত বছরও এই বিল থেকে ইরি ও আমন ধান ঘরে ওঠাতে পারেননি কৃষক। এর মধ্যে পানিতে তলিয়ে ছিল আমন ধান এবং শিলা বৃষ্টিতে বিনষ্ট হয়েছিল ইরি। এবারের বৃষ্টিতে আউশ, আমন পানির নিচে চলে যাওয়ায় একই ধরনের শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন কৃষক।
সিংহঝুলি গ্রামের মহিদুল ইসলাম বলেন, অবস্থা খুব খারাপ। নিচু জমির ধান সব পানির নিচে চলে গেছে। অধিকাংশ বীজতলা তলিয়ে গেছে। স্বরূপদাহ ইউনিয়নের বাঁওড়ের ধার দিয়ে যেসব বীজতলা ছিল তার সবই পানির নিচে চলে গেছে।
কৃষকরা জানান, এখন ধান রোপণের সময়। এ রকম বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে তা হয়তো আর সম্ভব হবে না। তবে সব শঙ্কার মধ্যেই ক্ষতির শিকার কৃষক নতুন করে বীজতলা তৈরির জন্য ধানবীজ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেছেন, পরিস্থিতির খোঁজখবর নিচ্ছি। আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকা কৃষি কর্মকর্তারা পরিদর্শন করছেন।
দফতরের কর্মকর্তারা পরিস্থিতির খোঁজ নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তারা যশোর সদর উপজেলার আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতির বিষয়টি কৃষক যাতে সামলে উঠতে পারে সে বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে সম্ভাব্য সব সহায়তা এবং পরামর্শ প্রদানেরও আশ্বাস দেন তিনি।