সড়কের পাশে কাঠের বাক্সের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন রতন কুমার দাস (৪৮)। গায়ে মলিন সাদা শার্ট আর পরনে পুরোনো লুঙ্গি। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষের ছেঁড়া জুতা সেলাই করতে করতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন এভাবেই জীবন সংগ্রাম করে টিকে আছেন। তবে রতন কুমার সাধারণ কোনও শ্রমজীবী নন। তিনি এক নারী মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনার ছেলে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নারী বীরত্বের সঙ্গে রণাঙ্গনে লড়াই করে সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম গাইবান্ধার রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা তাকে সাদুল্লাপুরের উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শুরু হয় ফুলমতির সংগ্রামী জীবন সংগ্রাম, যা এখনও চলমান। তার পথ ধরে একইভাবে জীবন সংগ্রাম চালাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরাও। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে অনেকের ভাগ্য বদলে গেলেও তাদের কোনও পরিবর্তন নেই। বিভিন্নভাবে কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করেন এই বীরাঙ্গনার সন্তানরা।
২৭ সেপ্টেম্বর বিকালে সাদুল্লাপুর উপজেলার চৌমাথা মোড়ে দেখা যায়, ছোট একটি বস্তা বিছিয়ে কাঠের বাক্স নিয়ে জুতা সেলাই করতে বসেছেন রতন। এরই মধ্যে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এখানে বসে জুতা সেলাই করেন রতন। গত কয়েক বছর ধরে এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
চৌমাথা মোড়ের ওষুধের দোকানি মহসিন আলী বলেন, ‘রতন শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হলেও কাজের প্রতি মনোবল আছে। দীর্ঘ সময় কেউ জুতা সেলাই করতে না এলে পত্রিকা পড়েন। মাঝেমধ্যে ঘুমিয়েও পড়েন বাক্সের ওপরে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রতন একা নন, তার পরিবারে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। রতনের বড় মেয়ে তৃষ্ণা রানী দাস লক্ষ্মী সাদুল্লাপুর সরকারি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়ছেন, মেজো ছেলে জীবন কুমার দাস একাদশ শ্রেণিতে, আর ছোট ছেলে স্বপন কুমার দাস পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে।
রতনের বাবা কুশিরাম সরকার ফসিয়ার মৃত্যু হয় ১৯৮৮ সালে। স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান তিনি। পরে এক ছেলে ও এক মেয়ে মারা যায়। সংসারের ভার একা বহন করতে হয় ফুলমতিকে। বড় ছেলে রতন ও নিরঞ্জন কখনও জুতা সেলাই কখনও দিনমজুরের কাজ করেন। ছোট ছেলে সুজন কুমার সরকারি দফতরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। অপর ছেলে মনিরাজ ২০১৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। এখন বাড়ির সামনে ছোট দোকানঘরে কম্পিউটার বসিয়ে ভূমি সেবা ও অনলাইনে কাজ করেন।
রতনের ছোট ভাই মনিরাজ কুমার জানান, ছোটবেলা থেকেই রতন দায়িত্বশীল। প্রতিবেশীর সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধে মারধরে আহত হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা করেও স্বাভাবিকভাবে চলতে বা কথা বলতে পারেন না। তবু জীবিকার তাগিদে জুতা সেলাই করছেন। মা এখন মৃত্যুশয্যায়, আর রতন ও নিরঞ্জন দীর্ঘদিন অসুস্থ। সামান্য সরকারি ভাতা দিয়ে সংসার চলে না। মা ও ছোট ভাই সুজন আলাদা করে খাবার ব্যবস্থা করেন। অন্য দুই ভাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার করছেন।
মনিরাজ আরও জানান, তিনি ও ছোট ভাই সুজন অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শেষ করেছেন। সুজন বর্তমানে নৈশপ্রহরীর চাকরি করছেন। কয়েক বছর আগে তিনি ভাড়া করা দোকানঘরে জুতা তৈরি ও সেলাইয়ের কাজও করতেন। মনিরাজ মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি পাননি। শেষ পর্যন্ত বাড়ির সামনে দোকান দিয়ে কম্পিউটার বসিয়ে ভূমি সেবা ও অনলাইনভিত্তিক কাজ করছেন। এতে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ৮২ বছরের বীরাঙ্গনা ফুলমতি স্ট্রোক ও বয়সজনিত কারণে শয্যাশায়ী। পরিবারকে সামান্য ভাতা দিয়েই চলতে হয়। ২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় তাকে পাকা ঘর দিয়েছিল। ২০২০ ও ২০২৩ সালে রতন ও নিরঞ্জনকে সরকারি খাসের জমি দিয়ে ঘর দেওয়া হয়েছিল। ফুলমতি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এখন তিনি প্রায় অবহেলিত। বিশেষ দিবসে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো আর মাসিক ভাতার টাকাই তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন।
অপরদিকে নারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও রতন কুমারের জীবন কাটছে ক্ষুধা, কষ্ট আর অবহেলায়। রতন জীবন সংগ্রামে অবিরাম লড়াই করেছেন। ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করছেন।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, রতন ও ফুলমতির পাশে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দাঁড়ানো উচিত। সমাজের বিত্তবানদেরও আহ্বান—রতনকে একটি দোকানঘর দিলে তিনি আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন। চিকিৎসা দিলে স্বনির্ভর হয়ে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরবে, লাঘব হবে অন্তত কিছুটা দুঃখকষ্ট।
এ ব্যাপারে সাদুল্লাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ আজমী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বার্ধক্যজনিত কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি নানা রোগে ভুগছেন। আমি নিজেও বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছি। কিন্তু ফুলমতির চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই। কেউ তার খোঁজও নেয় না। মৃত্যুর আগে তার চিকিৎসা জরুরি। দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতির জীবনযাপন এবং বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তার রাষ্ট্রীয় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, বসতঘর ও অন্যান্য সহায়তার জন্য তিনি নিজেও প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অবশেষে ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৩৩তম সভায় ফুলমতিসহ ২৬ জন বীরাঙ্গনাকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।’