দেশের অর্থনীতির এক সময়ের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল পাট। একসময় বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য হিসেবে যা ‘সোনালী আঁশ’ নামে খ্যাত ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কৃষি কাঠামোর পরিবর্তন, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে দিন দিন পেছনে পড়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী কৃষি পণ্যটি। উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ কম, আর জাগ দেওয়া বা পঁচানোর জায়গা ও পানির সংকটের কারণেই মূলত কমে যাচ্ছে পাটের চাষাবাদ।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর কালীগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট ৬৫০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। গত বছর চাষের পরিমাণ ছিল ৭১০ হেক্টর। হিসাব অনুযায়ী মাত্র এক বছরেই ৬০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ কমেছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাট চাষে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানি সংকট। আগে বর্ষা মৌসুমে খাল-বিল, ডোবা ও জলাশয়ে সহজেই পাট পঁচানো যেত। এখন বর্ষা কমে গেছে, খাল-বিল শুকিয়ে যায় অল্পদিনেই। যার ফলে পাট পঁচানোর প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না।
উপজেলার কোলা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের কৃষক এমদাদুল হক বলেন, ‘আগে খাল-বিলে পানি থাকতো, এখন সেসব প্রায় নেই বললেই চলে। পাট পঁচানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা এবং পানি না থাকায় বাধ্য হয়ে কৃষক অন্য ফসলে ঝুঁকছেন।’
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও পাটের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কামাল হাট গ্রামের কৃষক ইসমাইল মালিথা জানান, তিনি আগে প্রতি বছর দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করতেন। কিন্তু এখন মাত্র ১০ কাঠা করছেন। তিনি বলেন, ‘গত বছর প্রতি মণ পাট বিক্রি করেছি ২৮০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। কিন্তু সার, শ্রমিক, সেচ, পাট কাটার খরচের পর হাতে তেমন কিছু থাকেনি। এই কারণে এখন অনেক কৃষক লাভজনক অন্য ফসল চাষে ঝুঁকছেন।’
পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ ফেরাতে কৃষি বিভাগ প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করেছে। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনি বলেন, ‘চলতি মৌসুমে উপজেলার ৪০০ জন কৃষককে ৫ কেজি করে এমওপি ও ডিওপি সার এবং এক কেজি করে উচ্চফলনশীল পাট বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে এখন পাটের দাম তুলনামূলক ভালো হলেও পানি সংকট এবং লাভজনক অন্যান্য ফসলে কৃষকদের আগ্রহের কারণে পাটের আবাদ কমেছে এটা সত্যি।’
স্থানীয় কৃষকরা মনে করেন, শুধু প্রণোদনা নয়, পাট পঁচানোর জন্য খাল-বিল খনন, পানি সংরক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে পাট চাষে কৃষকের ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়বে।