চট্টগ্রাম নগরীতে সাত বছরে খাল-নালায় পড়ে ১৬ জনের মৃত্যু
বাংলাদেশ

চট্টগ্রাম নগরীতে সাত বছরে খাল-নালায় পড়ে ১৬ জনের মৃত্যু

চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার থানাধীন কাপাসগোলা এলাকায় হিজড়া খাল সংলগ্ন নালায় গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় বৃষ্টির মধ্যে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পড়ে যায়। ওই অটোরিকশায় মায়ের কোলে ছয় মাস বয়সী শিশুসহ তিন যাত্রী ছিলেন। বাকিরা উদ্ধার হলেও শিশুটি তলিয়ে যায়। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর সেহেরিশ নামে ওই মেয়ে শিশুটির মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার দূরে চাক্তাই খালে পাওয়া যায়। এ ঘটনার দুই মাস পর আবারও ঘটেছে একই ধরনের দুর্ঘটনা। এবার বল নিয়ে খেলতে গিয়ে বুধবার (৯ জুলাই) বিকালে নগরীর হালিশহর এলাকায় নালায় পড়ে মারা গেছে তিন বছরের শিশু হুমায়রা আক্তার।

বৃষ্টির পানির কারণে নালা এবং সড়ক একাকার হয়ে যায়। যে কারণে বোঝার উপায় ছিল না কোনটি সড়ক আর কোনটি নালা। সড়ক মনে করে নালায় পড়ে পানির স্রোতে তলিয়ে গেছে শিশু হুমায়রা। এভাবে সাত বছরে ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর এসব খাল ও নালা-নর্দমায় পড়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৬ জন।

গত ১৮ এপ্রিল শিশু সেহেরিশের মৃত্যুর পর নড়েচড়ে বসে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। বৃষ্টিতে বা জোয়ারের পানিতে অরক্ষিত খাল, নালা, ড্রেনে পড়ে প্রাণহানি ঠেকাতে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের তালিকা করার নির্দেশ দেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।

নির্দেশনা অনুযায়ী খাল, নালা ও ড্রেনের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করেন সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তালিকা অনুযায়ী ৪১টি ওয়ার্ডে মোট ৫৬৩টি জায়গাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১ নম্বর জোনে ৪৭টি, দুই নম্বর জোনে ৭৮টি, ৩ নম্বর জোনে ৬৮টি, চার নম্বর জোনে ৭৪টি, ৫ নম্বর জোনে ৩৩টি এবং ৬ নম্বর জোনে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত হয় ২৬৩টি। তালিকা অনুযায়ী দুর্ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন স্থানে ৮৬৩টি স্ল্যাব বসাতে হবে। এ ছাড়া বেষ্টনী নেই ১৫৬টি জায়গায়। সেগুলোতেও নিরাপত্তাবেষ্টনী দিতে হবে।

বছরে ১৬ জনের মৃত্যু

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে নগরীর এসব খাল ও নালা-নর্দমায় পড়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৬ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে এক, ২০১৮ সালে এক, ২০২১ সালে পাঁচ, ২০২২ সালে এক, ২০২৩ সালে তিন, ২০২৪ সালে তিন ও চলতি বছর দুই জন মারা গেছেন। এত প্রাণহানির পরও টনক নড়েনি সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। উন্মুক্ত নালাগুলো এখনও অরক্ষিত। কোনও ধরনের স্ল্যাব কিংবা নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে নিয়ে ক্ষুব্ধ নগরবাসী।

২০১৭ সালের ৩ জুলাই বাকলিয়ায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে পা পিছলে নালায় পড়ে যান হাটহাজারী উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। একইভাবে ২০১৮ সালের ৯ জুন নগরের আমিন জুট মিল এলাকায় আল আমিন নামে এক শিশু পা পিছলে ড্রেনে পড়ে যায়। পরে তারও লাশ উদ্ধার করা হয়।

২০২১ সালের ৩০ জুন নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেটের মেয়র গলির চশমা খালে পড়ে যায় সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা। এতে স্রোতে ভেসে যান চালক সুলতান আহমেদ (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)। পরে তাদের লাশ উদ্ধার হয়। গ্রাম থেকে শহরে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ওই নারী।

একই বছরের ২৫ আগস্ট জলাবদ্ধতায় নগরীর মুরাদপুরের চশমা খাল আর সড়ক একাকার হয়ে যায়। ওই দিন খালে পড়ে নিখোঁজ হন সবজিবিক্রেতা সালেহ আহমেদ। আজও তার খোঁজ মেলেনি। তার পড়ে যাওয়ার চিত্র ধরা পড়েছিল সিসিটিভি ক্যামেরায়। এরপর ঝুঁকিপূর্ণ খাল-নালা সুরক্ষার বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিন্তু গত প্রায় পাঁচ বছরেও এসব ‘মৃত্যুফাঁদ’ সুরক্ষিত করতে পারেনি সিটি করপোরেশন ও সিডিএ।

ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে নগরের আগ্রাবাদে নালায় পড়ে যাওয়ার সাড়ে চার ঘণ্টা পর বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার (১৯) লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। চশমা কিনে মামার সঙ্গে বাসায় ফিরছিলেন। ভাগনিকে উদ্ধারের জন্য মামা সঙ্গে সঙ্গে নালায় লাফ দেন। কিন্তু ব্যর্থ হন।

জলাবদ্ধতায় সড়ক আর ড্রেন-নালা একাকার হয়ে যায় ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর নগরীতে পানির স্রোতে চশমা খালে তলিয়ে যায় ১০ বছরের শিশু কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে মোহাম্মদপুর এলাকায় মির্জা খালে তার লাশ ভেসে ওঠে। একই বছর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় নালায় পড়ে কলেজের ইয়াসির আরাফাত নামে এক শিক্ষার্থীর পা ভেঙে গেছে।

জলাবদ্ধতার সময় ভেসে যাওয়া ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল শহরের কালুরঘাট এলাকার ওসমানিয়া খাল থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট নগরীর ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামী হাট সংলগ্ন বাদামতলা এলাকায় নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের (২০)। ওই বছরের ২৭ আগস্ট হালিশহর রঙ্গীপাড়ায় খোলা নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের টিম। পরের মাসে ১ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ এলাকায় সড়কের পাশে মহেশখালে পড়ে মারা যায় পাঁচ বছরের শিশু মো. আব্দুল।

২০২৪ সালের ২৭ মে নগরীর আছদগঞ্জের চাক্তাই খালে পড়ে প্রাণ হারান কলেজছাত্র আজিজুল হাকিম ইমন। একই বছরের ৯ জুন আগ্রাবাদ এলাকায় নাসির খাল থেকে সাত বছরের শিশু জসিম উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ৯ এপ্রিল সদরঘাট নালাপাড়া এলাকায় অরক্ষিত ড্রেনে পড়ে তিন বছরের শিশু ওজাইফার মৃত্যু হয়।

ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘নগরীর অধিকাংশ খাল-নালা উন্মুক্ত। রাতারাতি জলাবদ্ধতা দূর করা যাবে না। কারণ দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটসহ অদক্ষতার কারণে তা হয়ে উঠছে না। যেসব খাল-নালা সড়কের পাশে আছে, সেগুলোতে বেষ্টনী দেওয়া জরুরি। তা না হলে বৃষ্টি হলে নালা এবং সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়। তখন সড়ক নালা বোঝা যায় না। মূলত এ কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। খাল-নালায় পড়ে একের পর এক মৃত্যু ঘটলেও সিটি করপোরেশন ও সিডিএ নগরবাসীর সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করছে এই দুটি সংস্থা। এগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, অবহেলায় হত্যাকাণ্ড। এগুলো দেখারও কেউ নেই।’

চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘নগরীর খাল, নালা ও ড্রেনের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হচ্ছে। পরে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

Source link

Related posts

ফাঁকা ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী পণ্যের ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

News Desk

নিয়োগ নীতিমালায় গঠিত কমিটির সঙ্গে ডিনদের বৈঠক স্থগিত কেন?

News Desk

রাজশাহী মেডিকেলে আরও ১১ জনের মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment