কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন উপকূলের মাছ ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ

কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন উপকূলের মাছ ব্যবসায়ীরা

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী অঞ্চলে মৎস্য ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। এই খাতে রাজস্ব ফাঁকি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। পটুয়াখালী জেলার অন্যতম মৎস্য বন্দর কুয়াকাটা, আলীপুর ও মহিপুরের মাছ ব্যবসায়ীরা কৌশলে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। এসব বন্দরে প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ  বেচাকেনা হলেও খুব কম রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের জোরালো তৎপরতা না থাকায় প্রতি বছর সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাতে হয়। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহিপুর, আলীপুর ও কুয়াকাটা মৎস্য ঘাটে প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। কিন্তু এর বিপরীতে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না। ফলে দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনকে লোকসান গুনতে হয়।

মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা সরকারি অবতরণ কেন্দ্র এড়িয়ে মাছ কিনে নিজেদের ঘাটে মজুত করে রাখেন। পরে সেখান থেকে আড়ালে বিক্রি করে দেন, যা সরকারি রেকর্ডে আসে না। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে ডিজিটাল ওজন মেশিন, অনলাইন চালান ও ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত ঘাটগুলোকে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। মৎস্য খাতে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় প্রশাসন, রাজস্ব বিভাগ ও মৎস্য অধিদফতর একযোগে কাজ করলে প্রতি বছর চার-পাঁচ কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব। 

মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলার ঘাটগুলোতে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় মাত্র ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা। অথচ সঠিক নিয়ন্ত্রণ থাকলে এই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হওয়ার কথা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের সুবিধার জন্য ২০০৯ সালে দেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর আলীপুর ও মহিপুরে দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। ২০১২ সালে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে ১১০ শতাংশ জমিতে ১৫ কোটি টাকা বেশি ব্যয়ে আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এবং ১০৯ শতাংশ জমির ওপর ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর আলীপুরের ব্যবসায়ীরা অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বেচাকেনা করছেন। পাইকারি ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম থাকে আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি। কিন্তু নানা অজুহাতে বন্দরে মাছ না কিনে অনেকে ঘাটে মাছ কিনে তা গোপনে বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন।

আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের এক কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে, গত ১৩ জুলাই এফবি সাদিয়া-২ নামের ট্রলার বিভিন্ন সাইজের ৬৫ মণ ইলিশ বিক্রি করে ৩৯ লাখ ৬০ হাজার ১৪০ টাকায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, রাজস্ব আসার কথা ৪৯ হাজার ৫০১ টাকা। কিন্তু আড়তদার রাজস্ব দিয়েছেন মাত্র দুই হাজার টাকা। দুই হাজার টাকা হিসাবে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের খাতায় ১২৮ কেজি (তিন মণ আট কেজি) মাছ লেখা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বিএফডিসি মার্কেট ব্যবহার না করায় চাপ প্রয়োগ করেও তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলীপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খাপড়াভাঙ্গা নদীর দুই পাড়ে দুটি মৎস্য বন্দর। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন দুই পাড়ে দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র করেছে। মহিপুরের ব্যবসায়ীরা অবতরণ কেন্দ্রে না গিয়ে নিজস্ব গতিতে মাছ কেনাবেচা করছেন। এতে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না। ফলে জেলেদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ কোনও টাকা নেওয়া যাচ্ছে না। আমরা জেলেদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ টাকা কাটলেই শুরু হয় বিতর্ক। এজন্য রাজস্ব পরিশোধ করতে পারি না।’ 

আরেক ব্যবসায়ী আব্দুল মন্নান বলেন, ‘মহিপুরের ব্যবসায়ীরা সরকারি মার্কেটে মাছ ক্রয়-বিক্রয় করে রাজস্ব দিলে আমরাও সঠিকভাবে সরকারি রাজস্ব দেবো। অন্যথায় আমরা জেলেদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ টাকা কর্তন করলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। অনেক জেলে আলীপুরে মাছ বিক্রি না করে মহিপুরে বিক্রি করে দেন।’ 

এদিকে, জায়গা স্বল্পতার অজুহাতে মহিপুরের ব্যবসায়ীরা অবতরণ কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। তারা খাপড়াভাঙ্গা নদীর তীরে নিজস্ব ঘাটে মাছ কেনাবেচা করছেন। ফলে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায় করতে পারছেন না। 

মহিপুরের ব্যবসায়ীদের দাবি, মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটিতে ৪৫ জন ব্যবসায়ীর কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মহিপুরে নিবন্ধিত ব্যবসায়ী রয়েছেন ৮২ জন। কেন্দ্রের পন্টুনে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১০টি ট্রলার মাছ খালাস করতে পারে। কিন্তু ট্রলার রয়েছে এক হাজারের বেশি। এখানে পাইকার আছেন ২০০ জন, শ্রমিক রয়েছেন ৮০০ জন। এত লোকের উপস্থিতিতে মাছ ক্রয়-বিক্রয় করা যায় না। কারণ জায়গা কম। জায়গা স্বল্পতার কারণে শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিদিন মারামারি হয়। তাই ঘাটে নিজস্ব গদিতে মাছ বিক্রি করেন।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের সাবেক এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০০৯ সালে যখন এখানে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তখন মহিপুরে ৪০-৪৫ জন ব্যবসায়ী ছিলেন। ১১ বছর পরে ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অবতরণ কেন্দ্রটি চালু হলে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। যার ফলে জায়গা স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। জায়গা বাড়ালে ব্যবসায়ীদের এখানে আনা সম্ভব হবে।

মহিপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী মো. মজনু গাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এত অল্প জায়গায় আমাদের ব্যবসা করা সম্ভব না। বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ আমাদের পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করলে আমরা সেখানে যাবো। আমরা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করতে চাই না।’

আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র

বিএফডিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য মহিপুর ও আলীপুর প্রান্তে আলাদাভাবে অফিস ভবন, ৪০টি কক্ষবিশিষ্ট আড়ত ভবন, ১০ হাজার বর্গফুটের অকশন শেড, দুই হাজার বর্গফুটের প্যাকিং শেড, একটি পর্যবেক্ষণকক্ষ, ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বরফকল, একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দোতলা আবাসিক ভবন, একটি পাম্পহাউজ, দুটি নিরাপত্তাকক্ষ, একটি গণশৌচাগার, সাত হাজার বর্গফুট আয়তনের ট্রাক পার্কিং এবং নদীর দিকে একটি গ্যাংওয়ে ও একটি পন্টুন নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত হিসেবে শুধু আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে দুটি অকশন সেট নির্মাণ হয়েছে।

মহিপুর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজু আহম্মেদ রাজা বলেন, ‘বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ যখন অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল তখন প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা না করে তৎকালীন সরকারদলীয় কিছু অব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যার কারণে অবতরণ কেন্দ্রে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এখন আমাদের দাবি পূরণ করলে আমরা অবতরণ কেন্দ্রে যেতে রাজি আছি।’ 

ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. শরিফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মহিপুরের ব্যবসায়ীরা অবতরণ কেন্দ্র ব্যবহার না করায় রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। আর এই অজুহাতে আলীপুরের ব্যবসায়ীরা খেয়াল-খুশি মতো নামমাত্র রাজস্ব দিচ্ছেন। যার ফলে প্রায় ২৯ কোটি টাকার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে শুধুমাত্র ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ১১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা লোকসান গুনছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন।’

পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পরিধি বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের সেখানে নিতে হবে। জায়গা সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন।’ 

Source link

Related posts

নৌকায় শতভাগ ভোট চেয়ে সাকিব বললেন, ‘কথা দিচ্ছি, হতাশ করবো না’

News Desk

৮ বছরেও শেষ হয়নি প্রকল্প, ব্যয় বেড়েছে পাঁচ গুণ

News Desk

খাগড়াছড়িতে তুলা চাষে নতুন আশা

News Desk

Leave a Comment