কুমিল্লার সড়কে ৯ মাসে ৫২৫ মৃত্যু, কাজে আসছে না ১৫২ কোটির ক্যামেরা
বাংলাদেশ

কুমিল্লার সড়কে ৯ মাসে ৫২৫ মৃত্যু, কাজে আসছে না ১৫২ কোটির ক্যামেরা

অনিরাপদ হয়ে উঠেছে কুমিল্লার সড়ক-মহাসড়ক। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার সঙ্গে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। চলতি বছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ঘটেছে ৮৪২ দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫২৫ জন। পাশাপাশি আহত হয়েছেন এক হাজার ২১০ জন। ২০২৪ সালে ৬৩০ দুর্ঘটনায় ৫২২ জন নিহত ও ৭৮৪ আহত হয়েছিলেন। হিসাবে চলতি বছরের নয় মাসে গত বছরের দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। 

পাশাপাশি নিরাপত্তা ও যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২৫০ কিলোমিটারে প্রায় দেড় হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হলেও, সেগুলো কোনও কাজে আসছে না।

সড়ক অনিরাপদ হওয়ার কারণ কী

সড়ক অনিরাপদ হওয়ার পেছনে দুর্ঘটনাকে প্রধানত দায়ী করছে হাইওয়ে পুলিশ। যানবাহনের বেপরোয়া গতি, নিয়ম না মেনে ওভারটেকিং, মহাসড়কে দখল, ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা এবং অটোরিকশার মতো যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো, কার্যকর আইনের প্রয়োগ এবং বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা মোকাবিলা না করায় এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ট্রাফিক আইন না মানা, লাগামহীন গতি, থ্রি হুইলার, অদক্ষ চালক দিয়ে পরিবহন পরিচালনাসহ নানা কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়নের তথ্যমতে, কুমিল্লা রিজিয়নের আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, কুমিল্লা-নোয়াখালী, কুমিল্লা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৭৯২ কিলোমিটারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৪২টি দুর্ঘটনায় ৫২৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন এক হাজার ২১০ জন। হিসাবে কুমিল্লা রিজিয়নে প্রতিদিন গড়ে তিনটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন প্রাণ হারান ও পাঁচ জন আহত হন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজা থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত মহাসড়কে ৪৬৫টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৮৪ জন ও আহত হয়েছেন ৫০৯ জন। হিসাবে ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালের নয় মাসে কুমিল্লা রিজিয়নে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহত উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। 

দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণগুলো কী 

বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, নিয়ম না মেনে ওভারটেকিং এবং ওভারলোডিংয়ের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো বিপজ্জনক জোনে পরিণত হয়েছে। কিছু মহাসড়কে প্রায়ই ছিনতাই এবং ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। যা যাত্রীদের নিরাপত্তাহীন করে তুলছে। অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প সড়ককে মৃত্যুফাঁদ বানিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বৃদ্ধি পাওয়ায় সড়কগুলো পথচারীদের জন্য আরও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। নিরাপদ সড়কের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এবং বিদ্যমান অব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে অবনতি হচ্ছে দিন দিন। এর সঙ্গে আরও অব্যবস্থাপনা তো আছেই।

অতিরিক্ত গতির কারণে বেশি দুর্ঘটনা

অতিরিক্ত গতির কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানালেন পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কুমিল্লা কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ৪০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে। গতি নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালালেও অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে বিআরটিএ কিংবা হাইওয়ে পুলিশ কেউই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সক্রিয়তা ধরে রাখতে রাখতে পারছে না।’ 

অবৈধ যানবাহনে সয়লাব সড়ক

অবৈধ যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকে সড়ক-মহাসড়ক সয়লাব হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি অধ্যক্ষ কবির আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মহাসড়কে নছিমন, করিমন, থ্রি-হুইলার, অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও সব অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু এখন সব সড়কে এসব যানবাহন চলছে বিনা বাধায়। বৈধ গাড়ির চেয়ে অন্তত ২০ গুণ বেশি চলছে অবৈধ গাড়ি। দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে বৈধ গাড়ি এবং অবৈধ গাড়ির সংঘর্ষে। এ ছাড়া অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।’

অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক প্রসঙ্গে কবির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে মোট ৬২ লাখ যানবাহনের বিআরটিএতে রেজিস্ট্রেশন করা আছে। ৬২ লাখের মধ্যে ৪৬ লাখই মোটরসাইকেল। বাকিগুলো হলো বাস ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহন। অথচ এ যাবত সব মিলিয়ে ২৯ লাখ লাইসেন্স দিয়েছে বিআরটিএ। কী ভয়াবহ চিত্র। বাকি ৩৩ লাখ গাড়ি চালান লাইসেন্সবিহীন চালকরা। এ ছাড়া বিআরটিএর কাছে অবৈধ যানবাহনের সঠিক সংখ্যা ও তথ্য আছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে আমার। কারণ এক রোডে কী পরিমাণ যানবাহন চলবে, কতটি যান চলাচলের উপযোগী সড়ক, সেটি কখনও নির্ধারিত করে দেয়নি তারা।’

কাজে আসছে না সিসিটিভি ক্যামেরা

নিরাপত্তা ও যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে ১৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২৫০ কিলোমিটারে প্রায় দেড় হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো সম্পন্ন হয়েছিল গত বছর। তবে সব ক্যামেরা থেকে এখনও কোনও তথ্য নিতে পারছ না হাইওয়ে পুলিশ। বিশেষ কিছু এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে অতিরিক্ত গতির যানবাহন শনাক্ত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। তবে পুরো সড়কে যেসব ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, সেগুলো থেকে তথ্য পেলে আরও বেশি উপকার হতো বলে জানিয়েছে তারা।

হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত মহাসড়ক দুটি রিজিয়নে বিভক্ত। হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নের দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এবং গাজীপুর রিজিয়নের দাউদকান্দি থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত এআই সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে সাইনবোর্ড থেকে সিটি গেট পর্যন্ত ৪৯০টি পোলের মাধ্যমে বসেছে ক্যামেরা। এগুলো নিয়ন্ত্রণে মেঘনাঘাট, দাউদকান্দি, হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়ন ও সিটি গেট এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে মনিটরিং সেন্টার। তবে মূল কমান্ড সেন্টার হাইওয়ে পুলিশ সদর দফতরে। ক্যামেরা ও অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনের কাজ চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১৫২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আর ১০০টি ক্যামেরা বসানোর কাজ বাকি ছিল। ইতিমধ্যে সেগুলোও বসেছে। ২০২১ সালের জুনে ‘হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীন ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়। 

ক্যামেরা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব এখনও বুঝে পায়নি হাইওয়ে পুলিশ

হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিওনের পুলিশ সুপার অতিরিক্ত ডিআইজি শাহিনুর আলম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মহাসড়কের নিরাপত্তায় স্থাপন করা সিসি ক্যামেরাগুলো মনিটরিংয়ের দায়িত্ব এখনও হাইওয়ে পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আশা করছি, শিগগিরই আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে। বর্তমানে যেসব ক্যামেরা সচল রয়েছে, সেগুলো মেঘনা ঘাটে একটি কন্ট্রোল রুম থেকে মনিটরিং করছে হাইওয়ে পুলিশ। গত বছরের ৫ আগস্ট কিছু ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেগুলো এখনও মেরামত করা হয়নি। আশা করছি, সেগুলো দ্রুত মেরামত করা হবে। সবগুলো ক্যামেরা চালু হলে সুফল মিলবে।’

মহাসড়কে তিন চাকার যান বন্ধ করা সম্ভব নয়

মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি শাহিনুর আলম খান বলেন, ‘মহাসড়কে গণপরিবহন না বাড়ানো হলে তিন চাকার যানবাহন বন্ধ করা সম্ভব নয়। এখানে বহু মানুষের জীবিকা জড়িত। আমরা চেষ্টা করছি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যাতে সেগুলো না ঢোকে।’

খানাখন্দে ভরা সড়ক

হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিওনের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের। ৬২ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল। খানাখন্দ ও ভাঙাচোরা সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় এবং আঞ্চলিক সড়কগুলো ভেঙে আছে। সেগুলোতে ঘটছে দুর্ঘটনা।

কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সুগন্ধা পরিবহনের চালক আবুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে এমন কোনোদিন নেই যে দুর্ঘটনা ঘটে না। শুধুমাত্র সড়কের বেহাল অবস্থার কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে। ভাঙাচোরা সড়ক হওয়ায় বড় যানবাহনের সঙ্গে ছোট যানবাহনের সংঘর্ষে হতাহত হচ্ছে।’

কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আদনান ইবনে আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিগত বন্যা এবং এ বছরের বর্ষণে আমাদের দফতরের আওতায় কুমিল্লায় দেড়শ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় আছে। আগামী ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির মধ্যে সেগুলোর মেরামত শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি।’

Source link

Related posts

আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন

News Desk

২৩ কৃতী শিক্ষার্থীকে ভ্রমণ করানো হলো হেলিকপ্টারে

News Desk

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গণহত্যা দিবস পালন, মিছিল-সমাবেশে গণহত্যা বন্ধ ও বিচার দাবি

News Desk

Leave a Comment