নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর গ্রাম থেকে ফুলের রাজ্য গদখালিতে এসেছেন সাদিয়া ইয়াসমিন মুন। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। ফুলের রাজ্য গদখালিতে আসার অনেক দিনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে তার।
গদখালি থেকে সোজা চলে এসেছেন পানিসারায়; কৃষক ইসমাইল হোসেনের ফুলের বাগানে। চোখেমুখে বিস্ময় তার। তিনি বলেন, টেলিভিশন, ইউটিউব আর পত্রিকার পাতায় কেবল টিউলিপ ফুলের গল্প শুনেছি। আজ নিজ চোখে দেখলাম টিউলিপ ফুল। সামনাসামনি দেখে এত ভালো লাগছে কথায় বোঝানো যাবে না। আমি বিমোহিত, উদ্বেলিত।
যশোর কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, টিউলিপ মূলত পুষ্পজাতীয় উদ্ভিদ। বর্ষজীবী ও কন্দযুক্ত প্রজাতির গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Tulipa। সন্ধ্যার পর টিউলিপ ফুলের পাপড়ি বন্ধ হয়ে যায় এবং সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে পাপড়িগুলো মেলে ধরে। ফুলগাছের গড় উচ্চতা ১৭ সে.মি থেকে ৫০ সে.মি। Dutch Sunrise (Yellow) প্রজাতির ফুলের সেলফ লাইফ সব থেকে বেশি।
ফুলের ইতিহাস থেকে জানা যায়, পারস্যে লাল টিউলিপকে ভালবাসার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। টিউলিপ পামির মালভূমি ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে উদ্ভূত হয়ে কাজাখস্থানে স্থানান্তরিত হয়। যা পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, ইউরোপের দক্ষিণাংশ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়ার আনাতোলিয়া থেকে ইরানের পূর্বাংশ, চীনের উত্তর-পূর্বাংশ এবং জাপানে এই উদ্ভিদ পাওয়া যায়।
ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের কৃষক ইসমাইল হোসেন পরিচর্যা করছিলেন টিউলিপের। ৫ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক লাগিয়েছেন টিউলিপ। পলিথিনের শেডের নিচে নানা রঙে ঝলমল করছে এই সময়ের সবচেয়ে দামি ফুলগুলো। সবুজ কাণ্ড ও পাতার উপরে লাল, সাদা, হলুদ, জাম, লাল-হলুদ, সাদা-হলুদ, গোলাপি রঙের ফুলের সমারোহ।
তিনি বলেন, সরকারি খরচে কৃষি বিভাগ থেকে ৫ হাজার ফুলের বীজ পাই ২ জানুয়ারি। ৬ জানুয়ারি রোপণ করি। রোপণের ২৭ দিনের মাথায় গাছে ফুল এসেছে। টিউলিপের সৌন্দর্যে আমি নিজেই মুগ্ধ। গত কিছুদিন ধরে লোকজন বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা আসছেন বাগানে। সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি কিনছেনও। গতকাল পর্যন্ত বিক্রি করেছি ১০টি ফুল; প্রতি পিসের দাম নিয়েছি ১২০ টাকা।
নেদারল্যান্ডস থেকে এই ফুলের বীজ (কন্দ) এনেছে মৌমিতা ফ্লাওয়ারস। বীজপ্রতি খরচ ৭০ টাকা উল্লেখ করে ইসমাইল হোসেন বলেন, গদখালিতে আমিই প্রথম এই ফুলের চাষ করেছি। আসলে এর সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি, বিক্রির চিন্তা করছি না। দেখতেই মনে ভরে যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাতের কুয়াশা আর অতিরিক্ত সূর্যালোক থেকে রক্ষায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে শেড নির্মাণ করেছি। ২৪০ গুণ ৩৬ ইঞ্চি মাপের বেডে ৬ গুণ ৬ ইঞ্চির বেশি দূরত্বে বীজ বপণ করি। পানি নিষ্কাশনে ড্রেন এবং সার হিসেবে শুধুমাত্র জৈবসারই প্রয়োগ করেছি। প্রথম দফায় হয়তো কিছুটা ভুল ছিল, সেকারণে কিছু গাছ একটু দেরিতে গজিয়েছে। দর্শণার্থী ছাড়াও বেশকিছু ফুলচাষি এসেছেন। তারা চাষাবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইছেন। ইচ্ছে আছে, আমি বীজ প্রতি পিস বিক্রি করবো ১০০ টাকায়।
এই অঞ্চলের আরেক ফুল চাষি ইমামুল হোসেন বলেন, আমরা ফুল দেখে চাষ করি। এই অঞ্চলে জারবেরা চাষ বিস্তৃতি লাভ করে প্রায় চার বছর পরে। ইসমাইলের কাছ থেকে টিউলিপের চাষ পদ্ধতি জেনে নিয়েছি। সামনের বছর তার কাছ থেকে বীজ নেবো। এই ফুলের সৌন্দর্যরূপ খুবই সুন্দর।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের “বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের” মাধ্যমে দক্ষিণবঙ্গে প্রথম ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারায় টিউলিপ ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপ ফুলের বীজ সংগ্রহ করা হয়। মোট আট প্রজাতির টিউলিপ ফুলের বীজ আনা হয়েছে। ৫ হাজার টিউলিপ ফুলের বীজ ঝিকরগাছায় লাগানো হয়েছে। লাগানোর এক মাসের মধ্যে ফুল ফুটেছে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক উপ-পরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আসলে মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। দামি ফুলের ব্যবহার বেড়েছে। সর্বোচ্চ মূল্যমানের এই ফুলে লাভও বেশি। সামনে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস, আশা করা যায় এই ফুলটি ভালো দামেই বিক্রি হবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।