এতিম হয়ে গেলো চার মাসের শিশুটি, আরেকজনের মৃত্যুর খবর জানেন না মা-বাবা
বাংলাদেশ

এতিম হয়ে গেলো চার মাসের শিশুটি, আরেকজনের মৃত্যুর খবর জানেন না মা-বাবা

ছুটি কাটিয়ে ২১ দিন আগে বিদেশে গিয়েছিলেন বাবা সাহাবুদ্দিন। কে জানতো এটাই হবে শেষ যাওয়া। জানলে হয়তো যেতেন না। কারণ ঘরে আছে চার মাসের সন্তান। স্ত্রী-সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে এবং জীবিকার তাগিদে যেতে হলো প্রবাসে। কিন্তু এই যাত্রার মধ্য দিয়ে এতিম হয়ে গেলো তার চার মাসের কন্যাসন্তানটি। এখন সাহাবুদ্দিনের শিশুটিকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন দাদা। শোকে কাতর পুরো পরিবার।

গতকাল রবিবার বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টায় ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সাহাবুদ্দিন। তার সঙ্গে আরও সাত প্রবাসী নিহত হন। এর মধ্যে সাত জনের বাড়ি সন্দ্বীপ উপজেলায়। তার মধ্যে উপজেলার সারিকাইত ইউনিয়নের বাসিন্দা পাঁচ জন। এ ছাড়া মাইটভাঙার একজন ও রহমতপুর পৌরসভার রহমতপুর এলাকার একজন। অন্যজনের বাড়ি রাউজান উপজেলায়। তাদের সবার পরিবারে চলছে শোকের মাতম। 

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাগরে মাছ শিকার শেষে বাসায় ফেরার পথে ওমানের ধুকুম সিদ্দা এলাকায় তাদের বহন করা মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। এতে আট জন নিহত হন। তারা হলেন- সারিকাইতের আলী আকবর সেরাংয়ের ছেলে মো. আমিন মাঝি, শহীদুল্লাহর ছেলে মো. আরজু, মনু মিয়ার ছেলে মো. বাবলু, সিদ্দিক আহমেদের ছেলে সাহাবুদ্দিন, ইব্রাহিম মিস্ত্রির ছেলে মো. রকি, মাইটভাঙার জামাল উদ্দিনের ছেলে মো. জুয়েল ও সন্দ্বীপ পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের আবুল হাসেমের ছেলে মো. রনি এবং রাউজান উপজেলার মো. ইউসুফের ছেলে মো. আলাউদ্দিন।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বাংলাদেশি জানিয়েছেন, তারা সাগরে মাছ ধরা শেষে বাসায় ফিরছিলেন। পথে দুর্ঘটনার শিকার হন। নিহতদের লাশ ধুকুম হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

সারিকাইতে নিহত পাঁচ জনের সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সবার বাড়ি কাছাকাছি এলাকায়। স্বপ্ন ছিল বিদেশে আয় করে একসঙ্গে দেশে ফিরবেন। সংসারে সচ্ছলতা ফেরাবেন। কিন্তু স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেলো।

বৃহস্পতিবার সকালে সারিকাইত গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সাহাবুদ্দিন ও বাবলুর ঘরের সামনে প্রতিবেশীদের ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই বাবলুর ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। মেঝেতে বিলাপ করছেন তার মা জোসনে আরা বেগম। বারবার ছেলের কথা বলছিলেন। 

ছুটি শেষে ২১ দিন আগে ওমানে যান সাহাবুদ্দিন

ছুটিতে দেশে এসে ২১ দিন আগে ওমানে যান সাহাবুদ্দিন। তার বাবা সিদ্দিক জানিয়েছেন, দেড় বছর আগে বিয়ে করেছিল সাহাবুদ্দিন। তার ঘরে আছে চার মাস বয়সী আছিয়া আক্তার নামে এক কন্যাসন্তান। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে তার মা নাজমা বেগম বাকরুদ্ধ। সাহাবুদ্দিনের স্ত্রীর কান্না থামছে না। নাতনি আছিয়াকে কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন দাদা সিদ্দিক। বলছিলেন, ‘সংসারে সুখের জন্য ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছি। ২১ দিন আগে ছুটি শেষ করে ছেলেটা গেলো। এখন চার মাসের মেয়েটা এতিম হয়ে গেছে। ছেলে মঙ্গলবার দুপুরে ভিডিও কলে কথা বলেছে। মেয়েটাকে প্রাণভরে দেখেছে। কথা দিয়েছে, সাগর থেকে ফিরেই আবার ভিডিও কল দেবে। কিন্তু সেই ভিডিও কল এলো না। এলো মৃত্যুর খবর।’

ডিসেম্বরে বাড়ি আসার কথা ছিল আমিনের

আগামী ডিসেম্বরে দেশে ফেরার কথা ছিল আমিনের। ১৭ বছর ধরে বিদেশে আছেন। এবার বাড়ি এলে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের স্বপ্ন ছিল। আমিনের ছোট ভাই আকবর জানান, তার ভাইদের বহন করা মাইক্রোবাসকে দ্রুতগতির একটি লরি ধাক্কা দেয়। এতে মাইক্রোবাস দুমড়েমুচড়ে যায়। নিহতদের সবাই আমিন মাঝির অধীন কাজ করতেন। তারা একই বাসায় থাকতেন। ধুকুম এলাকায় ওমান সাগরে মাছ শিকার করতেন। কাঁদতে কাঁদতে আমিনের বাবা আলী আকবর বলছিলেন, ‘ছেলে এভাবে আমাদের ছেড়ে যাবে কখনও বুঝতে পারিনি। যদি জানতাম তাহলে বিদেশে পাঠাতাম না।’

‘আনিসা কারে বাপ ডাকবে’

আরজুর বাড়িতেও চলছে স্বজনদের আহাজারি। বাবা শহীদুল্লাহ ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে ‘আনিসা কারে বাপ ডাকবে’ বলে বিলাপ করছিলেন। আনিসা আরজুর তিন বছর বয়সী একমাত্র সন্তান। শহীদুল্লাহ জানান, তার ছেলে চার বছর আগে বিয়ে করে। ঘরে আছে তিন বছরের মেয়ে আনিসা। প্রথমবারের মতো বিদেশ গিয়েছিল আরজু। স্বপ্ন ছিল পরিবারের অভাব দূর করার। সে স্বপ্ন পূরণ হলো না। মৃত্যুর খবর এলো।

ছেলের মৃত্যুর খবর এখনও জানেনা মা-বাবা

রাউজানের আলাউদ্দিনের বাড়ি চিকদাই ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। বাড়িতে আছে তার অসুস্থ বাবা মো. ইউসুফ এবং মা আমেনা বেগম। একদিন পার হলেও ছেলের মৃত্যুর খবর জানেন না তারা। পরিবারের সদস্যরাও তাদেরকে ছেলের মৃত্যুর খবর এখনও শোনাননি।

আলাউদ্দিনের মেজো ভাই আল আমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মা-বাবা বয়স্ক এবং অসুস্থ। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছি কাল সন্ধ্যায়। আমরা চুপি চুপি কাঁদছি। মা-বাবাকে মৃত্যুর খবর দিইনি। তাদের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। ভাই দুই বছর আগে ওমানে গিয়েছিল। মাছ ধরার কাজ করতো। একদিন পরপরই মোবাইলে কথা হতো। এখনও বিয়ে করেনি। এবার এলে বিয়ে করানোর চিন্তা ছিল আমাদের। সে আশা আর পূরণ হলো। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমার ভাইয়ের লাশ দেশে আনার দাবি জানাচ্ছি।’

একসঙ্গে এত মৃত্যুতে গ্রামের সবাই শোকাহত

শোকে হতবিহ্বল সারিকাইত গ্রামবাসী। একসঙ্গে এত মৃত্যু মানতে পারছেন না তারা। সারিকাইত ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাসলিমা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বুধবার ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে সাত জন সন্দ্বীপের। এর মধ্যে পাঁচ জনের বাড়ি আমার ইউনিয়ন সারিকাইতে। একসঙ্গে এত প্রাণ নিভে যাওয়ায় গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমেছে। এতগুলো প্রাণের একসঙ্গে ঝরে যাওয়া মানতে পারছি না।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মংচিংনু মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লাশগুলো যাতে দ্রুত দেশে আনা যায়, সে ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলছি আমরা। পরিবারগুলোকে সার্বিক সহায়তা করা হবে।’

Source link

Related posts

সরকারকে বিপদে ফেলতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে সিন্ডিকেট: সমন্বয়ক রাসেল

News Desk

কুষ্টিয়া হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের মৃত্যু

News Desk

চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালে কর্মবিরতি, রোগীদের দুর্ভোগ

News Desk

Leave a Comment