ইচ্ছেমতো বসছে দোকান, পতেঙ্গা সৈকতের সৌন্দর্য ম্লান
বাংলাদেশ

ইচ্ছেমতো বসছে দোকান, পতেঙ্গা সৈকতের সৌন্দর্য ম্লান

চট্টগ্রামের অন্যতম দর্শনীয় স্থান পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক রূপ ও সৌন্দর্য। প্রশাসনের অবহেলা, অবৈধ দোকানপাটের দখলদারত্ব এই পর্যটনকেন্দ্রকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকরা। এ সমুদ্রসৈকতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে প্রতিমাসে ৩৬ লাখ টাকা করে আদায় করে নিচ্ছে একটি চক্র। ওই চক্রের সদস্যরা বর্তমানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দাবি দোকানিদের।

প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের প্রতিটি কোণায় গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক খাবারের দোকান ও অন্যান্য অস্থায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে দোকানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০। আছে ১০০ জন ভাসমান হকার এবং ৫০ জন ক্যামেরাম্যান। এসব দোকান দখল করে নিয়েছে হাঁটার পথ, বসার স্থান, এমনকি সিডিএ’র লাগানো গাছপালার জায়গাও। এ অবস্থায় সমুদ্রের ঢেউ আর বাতাস উপভোগ করতে এসে অনেক পর্যটকই ফিরে যাচ্ছেন বিরক্ত হয়ে।

শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে তিন স্তরে দোকান বসেছে। এর মধ্যে মূল সৈকতের ওপর দুইভাগে দোকান বসেছে। এমনকি সৈকতে ভাটার সময় আরেক দফা দোকান বসে। এখানে অধিকাংশ দোকান গড়ে উঠেছে হাঁটা-চলার পথ রুদ্ধ করে।

দোকানদারদের অভিযোগ, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে গড়ে উঠা প্রতিটি দোকানে তারা দৈনিক ভাড়া দেয়। কোনও দোকান ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দেয়। এখানে ১০০ জনের মতো হকার আছে। তারা ঝিনুকমালা, আচার, ডাব, বাদাম, ঝালমুড়িসহ নানা খেলনা বিক্রি করে থাকে। তাদেরও দৈনিক ১০০ টাকা করে দিতে হয়। একইভাবে এখানে ৫০ জনের মতো ক্যামেরাম্যান আছেন। তাদেরও দৈনিক ১০০ টাকা করে দিতে হয়। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী লোক ভাড়ার নামে এসব টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

সৈকতের খাবারের দোকানদার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে প্রতিমাসে দোকান বাড়ছে। নতুন দোকান বসালে অগ্রিম বেশি টাকা পাওয়া যায়। যার কাছ থেকে যত টাকা নেওয়া যায় যেমন ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপর দৈনিক ভাড়া। দোকান বাড়লেই তাদের লাভ। আগে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে আমাদের কাছ থেকে ভাড়ার নামে টাকা নেওয়া হতো। বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে বিএনপির না ভাঙিয়ে। স্থানীয় কিছু লোক এ টাকা নিচ্ছে। তারাই এখানে ইচ্ছেমতো দোকান বসাচ্ছে।’

এ দোকানি বলেন, ‘তাদের বাইরে এ সৈকতে একজন হকারও প্রবেশ করতে পারে না। সৈকতের প্রতিটি এলাকায় তাদের লোকজন আছে। এখানে ২৩০টি খাবারের দোকানসহ অন্তত ৩৫০ টি বিভিন্ন ধরনের দোকান আছে। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক গড়ে ৩০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। ৫০ জন ক্যামেরাম্যান এবং ১০০ জন হকারের কাছে দৈনিক নেওয়া হয় ১০০ টাকা করে।’

এ দোকানির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩৫০টি দোকান থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে আদায় হয় এক লাখ ৫ হাজার টাকা। ৫০ জন ক্যামেরাম্যান এবং ১০০ জন হকারের কাছে ১০০ টাকা করে দৈনিক নেওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এখানে দৈনিক এক লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করা হয় এসব দোকান থেকে। সে হিসেবে প্রতিমাসে এখান থেকে টাকা আদায় করা হয় ৩৬ লাখ টাকা।  

মোজাফ্ফর হোসেন নামে অপর এক খাবারের দোকানি বলেন, ‘এখানে দোকান বসতেও টাকা দিতে হয়। আবার প্রতিমাসেও টাকা দিতে হয়। দোকানের সাইজ অনুযায়ী এ টাকা দিতে হয়। বর্তমানে স্থানীয় বিএনপির লোকজন এ টাকা নিচ্ছে।’

খাবারের ইচ্ছেমতো দাম রাখার অভিযোগ

চট্টগ্রামে বিনোদনের স্থান এমনিতেই সীমিত। তার মধ্যে নগরের ষোলশহর ২ নম্বর গেটে অবস্থিত বিপ্লব উদ্যান, কাজির দেউড়ি শিশুপার্ক, আগ্রাবাদের কর্ণফুলী শিশুপার্ক এবং বহদ্দারহাটের স্বাধীনতা কমপ্লেক্স বন্ধ থাকায় পতেঙ্গা সৈকতে দর্শনার্থীর চাপ অনেক গুণ বেড়েছে। 

ট্যুরিস্ট পুলিশের তথ্যমতে, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে সাধারণ দিনে ৭ থেকে ১০ হাজার দর্শনার্থী এলেও ছুটির দিনে তা অর্ধলাখ ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ সময়ে যেমন ঈদে লাখেরও বেশি মানুষের সমাগম ঘটে।

পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা নগরীর মুরাদপুর সংগীত এলাকার বাসিন্দা কাশবি আক্তার বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এখন পুরোটাই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানে হাঁটা-চলার পরিবেশও নেই। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে খাবারের দাম অস্বাভাবিক। দাম না জেনে কিছু নিলে দোকানদাররা ইচ্ছেমতো টাকা দাবি করেন। তদারকির কেউ নেই, অভিযোগের জায়গাও নেই। যে কারণে দর্শনার্থীরা অনেকটাই অসহায় হয়ে থাকেন।’

প্রতিমাসে আসে ৩৬ লাখ টাকা কিন্তু যায় কার পকেটে?

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য ধ্বংসের অধিকার কারও নেই। এখানে অনেক দোকান গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। শিগগিরই অবৈধ দোকান উচ্ছেদে অভিযান পরিচালিত হবে।’

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় দায়িত্বরত ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক মে. কামরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সমুদ্রসৈকতে আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কারা দোকান বসাচ্ছে, কোথায় বসাচ্ছে সেসব দেখার বিষয় সিডিএ-জেলা প্রশাসনের। তবে এখানে অপরিকল্পিত দোকানপাটের কারণে দর্শনার্থীদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গা-ফৌজদারহাট আউটার রিং রোড প্রকল্পের আওতায় সৈকতের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়। তবে স্থানীয় দখলদারদের দৌরাত্ম্যে সৈকতের সৌন্দর্য এখন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

পতেঙ্গা থানা বিএনপির সভাপতি ডা. নুরুল আবছার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে দোকান বসানো কিংবা তুলে দেওয়ার বিষয়টি করছে জেলা প্রশাসক। কেননা এ পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই জেলা প্রশাসকের হাতে। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য রয়েছে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। এ কমিটি এখানে দেখভাল করছেন। আগে কি হতো সেটা এখন বলে লাভ নেই। এখন সরকারি লোকজনই সরকারনির্ধারিত অর্থে দোকান বসাচ্ছে। এখানে বিএনপির নেতাকর্মীদের কোনও হাত নেই। কেউ বলে থাকলে তা মিথ্যে বলেছে।’

Source link

Related posts

গ্রেফতারের আগে রাঙামাটিবাসীর কাছে বিচার চাইলেন ফজলে এলাহী

News Desk

রাজশাহী মেডিকেলে ২৪ ঘণ্টায় ২১ জনের মৃত্যু

News Desk

সার্ভার সমস্যার কারণে জন্ম সনদ পেতে ভোগান্তি

News Desk

Leave a Comment