আমার চোখের সামনে ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে, পানিও দিতে দেয়নি
বাংলাদেশ

আমার চোখের সামনে ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে, পানিও দিতে দেয়নি

চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে মব সৃষ্টি করে স্কুলছাত্র রিহান উদ্দিন মাহিনকে (১৫) গণপিটুনিতে হত্যার পর তার পরিবারে চলছে মাতম। এ ঘটনায় আহত মানিক (১৫) ও রাহাত (১৫) দুজনই গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে এখনও জ্ঞান ফিরেনি রাহাতের।

এদিকে, শনিবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফু ইসলাম সানতু। অপরদিকে মাহিনকে হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী।

শুক্রবার ভোরে উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের সাকর আলী তালুকদার বাড়ির চেইঙ্গার ব্রিজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত মাহিন ওই এলাকার দোকানি মুহাম্মদ লোকমান ও গৃহিণী খদিজা বেগম দম্পতির ছেলে এবং কাঞ্চননগর উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। আহত অপর দুইজন হলো- একই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মাইজপাড়া এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মানিক ও মো. ইউসুফের ছেলে রাহাত। এ দুজনই স্থানীয় হজরত শাহেনশাহ জিয়াউল হক উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।

শনিবার বিকালে উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নে নিহত মাহিনের ঘরে গিয়ে দেখা গেছে, টিনশেডের জরাজীর্ণ ঘরের চারপাশে প্রতিবেশী আর স্বজনদের ভিড়। এখনও বিলাপ করছেন নিহত মাহিনের বাবা ব্যবসায়ী মুহাম্মদ লোকমান ও মা খদিজা বেগম। উপস্থিত লোকজন তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাতেও কোনও কাজ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা খদিজা বেগম।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে খদিজা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার চোখের সামনে আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে। পানি চেয়েছিল-পানিও দিতে দেয়নি। কী নির্দয়ভাবে ব্রিজের সঙ্গে বেঁধে মেরেছে। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’

নিহতের বাবা লোকমান জানিয়েছেন, মাহিন, রাহাত ও মানিক তিনজনই সমবয়সী বন্ধু। তিনজনের বাড়ি একই এলাকায়। গত ২১ আগস্ট তিন বন্ধু মিলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে পরদিন ২২ আগস্ট মধ্যরাতে চট্টগ্রামে আসার পর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাড়ি ফিরে। বাড়ির অদূরে সড়কে সিএনজি অটোরিকশাটি থামিয়ে ঘরে যায় ভাড়ার টাকা আনতে। গাড়িতে সিএনজিচালক ও দুই বন্ধু রাহাত ও মানিক ছিল। মাহিনের ভাড়ার টাকা নিয়ে আসতে দেরি হওয়ায় তার দুই বন্ধুও গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করে। এ সময় মাহিনও চলে আসেন। স্থানীয় কিছু লোক তাদেরকে দেখে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে তাড়া করেন। একপর্যায়ে তিনজনই প্রাণ রক্ষায় পার্শ্ববর্তী একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে উঠে যায়। সেখান থেকে তাদেরকে নামিয়ে চেইঙ্গার ব্রিজের ওপর এনে বেঁধে রাখা হয়। বেশ কয়েকজন লোক তাদেরকে চোর আখ্যা দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে। এতে পিটুনিতে মাহিনের মৃত্যু হয়। পরে পুলিশ এসে অপর দুজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।

লোকমান আরও বলেন, ‘আমি ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে গেলেও আমাকেও মারধর করা হয়। আমি বলেছি, আমার ছেলে কোনও চুরির সঙ্গে জড়িত থাকলে এর ক্ষতিপূরণ আমি দেবো। তারা শুনেনি। আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে মারতে মারতে মেরে ফেলেছে। নাজিম উদ্দিন, নোমান, আজাদ হোসেন, তৈয়ব, মহিউদ্দিনসহ আরও বেশ কয়েকজন চোর আখ্যা দিয়ে মেরেছে। আমি তাদের বিচার চাই।’

মাহিনের বাবা লোকমান স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ক্যান্টিন চালান। বাড়তি রোজগারের জন্য ছয় মাস আগে বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকান দেন। স্কুল ছুটি শেষে সেখানে সময় দিতো মাহিন, বেচা-বিক্রিতে সহযোগিতা করতো বাবাকে।

নিহত মাহিনের ফুফু সুখী বেগম বলেন, ‘মাহিন মৃত্যুর আগে পানি চেয়েছিল। পাষাণ লোকগুলো আমাকে পানি নিয়ে যেতে দেয়নি। মাহিনকে পরিকল্পিতভাবে মেরেছে। এর সঙ্গে যারা দায়ী তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।’

এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী রাহাতের মা রোজি আক্তার বলেন, ‘মাহিন, মানিক ও আমার ছেলে রাহাত বন্ধু। তারা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। আসার পথে মানিককে নামিয়ে দিতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। আমার ছেলে রাহাতের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তারা স্কুলের ছাত্র। এমন কী অপরাধ করেছে তাদেরকে এভাবে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে। আমার ছেলের শরীরে অনেক জখম হয়েছে। আমি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করছি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমাকে নিহত মাহিনের বাবা লোকমান সকাল ৬টার দিকে জানায়। তখন আমি পুলিশকে ফোন দিয়েও সংযোগ পাইনি। পরে তার মা জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। চুরির অপবাদ দিয়ে ছোট ছোট স্কুলছাত্রকে মারধর করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।’

এ ঘটনায় ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে নিহত মাহিনের মা খদিজা বেগম বাদী হয়ে ফটিকছড়ি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৫ জনের নাম উল্লেখসহ ৭ থেকে ৮ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। পুলিশ এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামির মধ্যে নোমান ও আজাদ নামে দুই জনকে গ্রেফতার করেছে।

এদিকে, শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু। এ সময় তিনি নিহতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। অপরদিকে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে শনিবার দুপুরে গ্রামবাসীর উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর আহমেদ বলেন, ‘এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান আছে।’

Source link

Related posts

আগুনে পুড়ে ছাই ১৩ দোকান

News Desk

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল শুনানি শুরু

News Desk

ধসে পড়েছে গাজী টায়ার্সের তিনটি ফ্লোর, ড্রোন ক্যামেরায় মেলেনি মরদেহ

News Desk

Leave a Comment