৪০ এতিম কন্যার যৌতুকবিহীন বিয়ে
বাংলাদেশ

৪০ এতিম কন্যার যৌতুকবিহীন বিয়ে

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা মারা যান ইয়াসমিন আরার। এরপর চলে আসেন এতিম বালিকাদের জন্য গঠিত দিনাজপুর শিশু নিকেতনে। পড়াশোনা করেন এইচএসসি পর্যন্ত। গত বছর পার্বতীপুর উপজেলার মোহাম্মদপুর এলাকার আব্দুর সাত্তারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। গত দুই বছরে তার মতো ৪০ এতিম কন্যাকে যৌতুকবিহীন বিয়ে দিয়েছে শিশু নিকেতন।

শুক্রবার (২৭ মে) দুপুর আড়াইটার দিকে শহরের বালুবাড়ীস্থ গ্রিন ভিউ কমিউনিটি সেন্টারে এই ৪০ দম্পতিকে বিবাহত্তোর সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিশু নিকেতন।

অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, পাশাপাশি বসে রয়েছেন ৪০ বর ও ৪০ কনে। তাদের পাশে বসেছেন অতিথিরা। সবার মাঝে ছিল উচ্ছ্বাস। আয়োজনের কোনও কমতি ছিল না। তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করেছেন সবাই। 

শিশু নিকেতনের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, বিয়ে দেওয়া কন্যাসন্তানরা এতিম। তবে তারা নানাভাবে স্বাবলম্বী। বরদের মধ্যে কেউ পোশাক কারখানায়, কেউ কোম্পানি, কেউ ব্যবসায়ী আবার কেউ কৃষিকাজ করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী র্কমর্কতা জয়নুল আবেদিন, দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রেজা হুমায়ুন ফারুক চৌধুরী শামীম ও শিশু নিকেতন পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোজাফ্ফর আলী মিলন। 

অনুষ্ঠানে বরদের একটি করে বাইসাইকেল, কনদের একটি করে সেলাই মেশিন, প্রাইজবন্ড, লেপ-তোশক, বালিস ও সংসারের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র উপহার দেওয়া হয়।

ইয়াসমিন আরা বলেন, ‘চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা মারা যান। তখন থেকেই শিশু নিকেতনে থাকতে শুরু করি। এখানে অতিবাহিত করলাম নয় বছর। এখানে থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। তারপর বিয়ে হলো। শিশু নিকেতন আমাদের জন্য যা করেছে, তা আজীবন মনে থাকবে। তারা না থাকলে হয়তো আমরা এতদূর আসতে পারতাম না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন, যাতে বাকি জীবন সুখে-শান্তিতে কাটাতে পারি।’

ইয়াসমিন আরার স্বামী আব্দুর সাত্তার বলেন, ‘শিশু নিকেতনের দায়িত্বশীলদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা ভালো একজন জীবনসঙ্গী আমাকে দিয়েছেন। আমি কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। আমরা ভালো আছি।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম

রানীগঞ্জ এলাকার পিংকি আক্তার বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই শিশু নিকেতনে বড় হয়েছি। তাদের আদর-যত্নে অনেক বছর পার করেছি। শিশু নিকেতনের দায়িত্বশীলরা আমার বাবা-মা। তাদের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। কাজকর্ম শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে তারা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন। ভালো শিক্ষা দিয়েছেন। ভালো পরিবার উপহার দিয়েছেন। আমি অনেক খুশি।’

বর মাজেদুর রহমান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল এতিম কাউকে বিয়ে করার। ইচ্ছা পূরণ করেছেন আল্লাহ। পরিবার ও শিশু নিকেতন এই বিয়েতে এগিয়ে আসায় তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদার গ্রামের বর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি টেইলার্সের ব্যবসা করি। শিশু নিকেতনের কন্যা লিজা আক্তারকে বিয়ে করেছি। আমরা যেন সুখী হতে পারি, সবাই দোয়া করবেন।’

হামজাপুর গ্রামের রবিউল ইসলামের বাবা রায়হানুল ইসলাম বলেন, ‘যৌতুক ছাড়াই ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি। আমি চাই, সব অভিভাবক এই কাজটি করুক। ছেলে ও পুত্রবধূর জন্য দোয়া করি। তারা সুখী হোক।’

পাশাপাশি বসে রয়েছেন ৪০ বর ও ৪০ কনে

দিনাজপুর শিশু নিকেতনের সভাপতি মোজাফফর আলী মিলন বলেন, ‘১৯৭৯ সালে ১০ জন এতিম বালিকাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে শিশু নিকেতন। এখানে এতিমদের এইচএসএসি পর্যন্ত পড়ালেখা শিখিয়ে ১৮ বছর হলে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে একসঙ্গে ২০ এতিম মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে করোনার কারণে একসঙ্গে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ৪০ এতিম মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব মেয়ে স্বাবলম্বী। প্রত্যেকে ড্রেস মেকিং ও হ্যান্ডিক্রাফট প্রশিক্ষণ, রান্নাবান্না প্রশিক্ষক, কম্পিউটার শিক্ষা, খেলাধুলা ও সংগীত চর্চায় পারদর্শী। এ পর্যন্ত নিকেতনের ১৭৪ মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এখানে রয়েছে ১০৬ কন্যাশিশু।’

জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম বলেন, ‘মহৎ কাজের পাশাপাশি এতিমদের পাশে সবার এগিয়ে আসা উচিত। আজ এসব মেয়েকে যারা বিয়ে করেছেন তাদের মঙ্গল কামনা করছি। যৌতুক আমাদের সমাজে একটি ব্যাধি। এই ব্যাধি থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। যৌতুক ছাড়া ৪০ যুবক বিয়ে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এখানে যারা কর্মহীন আছেন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। দিনাজপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল, আইটি পার্কসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের চাকরি দেওয়া হবে। যাতে সুন্দরভাবে সংসার চালাতে পারেন তারা।’

Source link

Related posts

দেশে ২৪ ঘণ্টায় আরও ২১৮ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে

News Desk

ইফতার ও সাহরিতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে : স্থানীয় সরকারমন্ত্রী

News Desk

মধুমতি নদী থেকে নিখোঁজ স্কুল ছাত্রীর লাশ উদ্ধার

News Desk

Leave a Comment