‘সবাইকে ম্যানেজ করা আছে, দুদক কিংবা কেউ কিছুই করতে পারবে না’
বাংলাদেশ

‘সবাইকে ম্যানেজ করা আছে, দুদক কিংবা কেউ কিছুই করতে পারবে না’

নামে-বেনামে অনিয়মিত শ্রমিক, মৃত ব্যক্তি এবং প্রবাসীদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব খুলে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করছেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) নোয়াখালীর উপপরিচালক (বীজ বিপণন ও এএসসি) নুরুল আলম। বিএডিসির বীজ বিপণন শাখার নথিপত্র পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া যায়। তবে এসব বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলছেন, ‘সবাইকে ম্যানেজ করা আছে, দুদক কিংবা ঊর্ধ্বতন কেউ আমার কিছুই করতে পারবে না।’

বিএডিসির নোয়াখালী কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপপরিচালক নুরুল আলম নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বীজ বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিএডিসির পক্ষ থেকে এই তিন জেলার কৃষকদের বীজ সরবরাহ করা ও সে লক্ষ্যে বীজ সংগ্রহ-ক্রয়ের কাজটিও হয় তার অধীনে। এই কাজেই করেছেন অনিয়ম। মৃত ব্যক্তি, প্রবাসী ও অনিয়মিত শ্রমিকদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব খুলে অর্থ আত্মসাৎ করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএডিসিতে কৃষকদের অভিযোগের পরও তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিএডিসি। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় কৃষক ও কার্যালয়ের কর্মচারী এবং ডিলাররা।

স্থানীয় কৃষক ও ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নুরুল আলম নামে-বেনামে অনিয়মিত শ্রমিকের নামে বছরের পর বছর হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। আবার ঘুষ না দিলে বরাদ্দকৃত বীজ পাচ্ছেন না চুক্তিবদ্ধ ডিলাররা। কার্যালয়ের কেউ তার এসব অপকর্মের বিষয়ে কথা বললে বদলি বা রোষানলের শিকার হতে হয়। 

কার্যালয়ের কর্মচারীরা বলছেন, দারোয়ান, ঝাড়ুদার, চাষি, অনিয়মিত শ্রমিক, কৃষি সার্ভিস সেন্টারের কর্মচারীদের অনিয়মিত শ্রমিক সাজিয়ে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ ছাড়া সরকারি কাগজে-কলমে প্রশিক্ষণ ভাতা উত্তোলন করলেও প্রশিক্ষণের তালিকায় থাকা অনেকে বিষয়টি জানেনই না।

কার্যালয়ের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বিএডিসির নোয়াখালী কার্যালয়ে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ছিলেন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার চকরা গ্রামের তুলুপুকুরিয়া বাড়ির আব্দুল মুনেফের ছেলে আবুল কাশেম মনির হোসেন। অসুস্থতাজনিত কারণে ২০২৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। সেদিন বিকালে মনির হোসেনকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হলেও বিএডিসির কাগজে-কলমে এখনও জীবিত থেকে মজুরি নিচ্ছেন। মৃত্যুসনদ অনুযায়ী, তিনি এপ্রিল মাসের ২০ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তবে বিএডিসির হাজিরা খাতায় জীবিত। তার নামে মজুরি ও গত ঈদ বোনাস তোলা হয়েছে।

বিএডিসি কার্যালয়ের বীজ বিপণন শাখার তথ্য বলছে, এপ্রিল মাসে মনির হোসেন ২২ দিন কাজে উপস্থিত ছিলেন। নিয়েছেন মজুরি। যদিও এর কিছুই পায়নি বলে দাবি করেছেন মৃত মনির হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। একইভাবে ২০২৪ সালের মে মাসের হাজিরা খাতায় আবুল কাশেম নামে স্বাক্ষর করে মজুরি তোলা হয়েছে। জুন মাসে একই শাখা থেকে ঈদুল আজহার বোনাস হিসেবে সাত ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। অথচ আবুল কাশেমের পরিবার এ বিষয়ে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছে।

একইভাবে সাইফুল ইসলাম নামে এক চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক একই সময়ে বিএডিসির অ্যাগ্রো সার্ভিস সেন্টার এবং বীজ বিপণন শাখায় কাজ করেছেন বলে হাজিরা খাতায় দেখানো হয়েছে। তিনি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চুক্তিভিত্তিক চাষি হিসেবেও চার লাখ সাত হাজার টাকা মজুরি পেয়েছেন। সাইফুলের ভাই শামসুল ইসলাম প্রবাসে থাকলেও তার নামে মজুরি তোলা হয়েছে। এ ছাড়া মনির হোসেনের স্ত্রী মুক্তা আক্তার (যিনি নোয়াখালীতে কখনও আসেননি) তাকেও অনিয়মিত শ্রমিক হিসেবে দেখিয়ে মজুরি তুলে আত্মসাৎ করা হয়। 

বিএডিসি কার্যালয়ের বীজ বিপণন শাখার তথ্য বলছে, সাইফুল ইসলাম ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাস একই সময়ে কাজ করেছেন অ্যাগ্রো সেন্টার এবং বিপণন শাখায়। প্রতি মাসে অ্যাগ্রো সেন্টার থেকে ২৯ দিন এবং বীজ বিপণন থেকে ২২ দিনের ভাতা তুলেছেন। আবার বিএডিসি ছেড়ে চুক্তিভিত্তিক চাষি হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিয়েছেন চার লাখ সাত হাজার টাকা। একই ব্যক্তি একই দিনে দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠানে কীভাবে কাজ করেছেন তার উত্তর দিতে পারেননি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। আবার সাইফুল ইসলামের ছোট ভাই শামসুল ইসলাম ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রবাসে পাড়ি দিলেও সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অ্যাগ্রো সেন্টার থেকে অনিয়মিত শ্রমিক হিসেবে টাকা তুলেছেন বলে খাতায় উল্লেখ করা হয়।

Monir Hossain Death certificate

বিপণন শাখার অনিয়মিত শ্রমিকদের হাজিরা খাতা তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখে এখানে কাজ করেছেন মুক্তা আক্তার। যদিও এখন পর্যন্ত প্রতি মাসে হাজিরা না থাকা সত্ত্বেও মজুরি পাচ্ছেন মুক্তা। অথচ মুক্তা আক্তার মৃত মনির হোসেনের স্ত্রী। যিনি কখনও নোয়াখালীতে আসেননি। চাঁদপুরে বসবাস করেও বিএডিসির নোয়াখালী কার্যালয়ে প্রতিদিন কাজ করে শ্রমিকের মজুরি তুলেছেন। 

মনির হোসেন, সাইফুল ইসলাম, শামসুল ইসলাম ও মুক্তা আক্তারের মতো এমন ১৫ জনের নামে বিএডিসির অ্যাগ্রো সার্ভিস সেন্টার ও বীজ বিপণন থেকে নিয়মিত মজুরি তোলা হচ্ছে। চাকরি না করেও অনেকে পাচ্ছেন বোনাস। রহমত উল্যাহ রাজু নামে এক অটোরিকশাচালক অনিয়মিত শ্রমিক হিসেবে মজুরি নিচ্ছেন। অথচ যার কোনও অস্তিত্বই নেই এই অফিসে। মূলত তাদের নামে এসব অর্থ আত্মসাৎ করেন নুরুল আলম।

নথিপত্রে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ ভাতার নামে অর্থ উত্তোলন করা হলেও তালিকাভুক্ত অনেকে প্রশিক্ষণে অংশ নেননি। অনিয়মিত শ্রমিকদের হাজিরা ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ কর্মকর্তা ও হিসাবরক্ষণ শাখার কাছে থাকার কথা থাকলেও তা নুরুল আলমের কক্ষে তালাবদ্ধ রেখে হিসাব পরিচালনা করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৬ ও ২৩ নভেম্বর নোয়াখালীতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভুয়া চালানের মাধ্যমে ধান ও বীজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই সিলেট এবং সুনামগঞ্জে বিক্রি করেন নুরুল আলম। এ ছাড়া সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বিল উত্তোলন করেন এই কর্মকর্তা।

নুরুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ঘুষ ছাড়া ডিলারদের বীজ বা সার সরবরাহ করেন না। তার ভাই সাইফুল আলমকে বিএডিসির ফার্নিচার সরবরাহের ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সাজানো দরপত্রের অভিযোগ আছে। এ ছাড়া অফিসের গুরুত্বপূর্ণ নথি যা হিসাবরক্ষণ শাখার কাছে থাকার কথা তা তিনি নিজের কক্ষে তালাবদ্ধ রাখেন।

এসব অনিয়মের পাশাপাশি শ্রমিকদের দিয়ে বাড়তি পরিশ্রম করিয়ে মজুরি না দেওয়ার অভিযোগ আছে। কাগজপত্রে ‘ওভার টাইম’ পরিশোধ দেখিয়ে সে টাকা নিজেই আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। শ্রমিকদের হাজিরা খাতায়ও গরমিল আছে। খাতায় চার জন শ্রমিকের নাম থাকলেও কাজ করেছেন দুজন।

দৈনিক মজুরিভুক্ত শ্রমিক জাহিদ বলেন, নুরুল আলম আমাদের আট ঘণ্টার পরিবর্তে ১২-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করেন। কিন্তু বাড়তি মজুরি দেন না। অথচ পরে শুনি আমাদের ওভারটাইমের বিল অফিস দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা কখনও তাই পাইনি।

noakhali.2jpg

দৈনিক হাজিরা খাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খাতায় চার জন শ্রমিকের প্রতিদিন কাজে দেখালেও সেখানে কাজ করছিলেন জাহিদ ও বেলাল নামে দুজন শ্রমিক। নো ওয়ার্ক নো পে অনুযায়ী তাদের বেতন হলেও হাজিরা খাতায় গরমিল দেখা গেছে। খাতায় ঘষামাজা, কাটাছেঁড়া দেখা গেছে।

অনিয়ম ও দুর্নীতির এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল আলম এই প্রতিবেদককে নগদ অর্থ এবং অনিয়মিত চাষি দেখিয়ে প্রতি মাসে অর্থ দেওয়ার অফার করেন। তার অফার প্রত্যাখ্যান করে বক্তব্য জানতে চাইলে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিভিন্ন নথিপত্র ঠিক করে তারপর নেওয়ার অনুরোধ জানান। এরপর ফোন দিয়ে নথিপত্র চাইলে মানহানি মামলা করার হুমকি দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‌‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। মহাব্যবস্থাপক নিজেই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। স্যার সব জানেন। আপনার কথার পাত্তা দেবে না স্যার। সবাইকে ম্যানেজ করা আছে। দুদক কিংবা ঊর্ধ্বতন কেউই কিছুই করতে পারবে না।’

নুুরুল আলমের এসব নানা অনিয়মের বিষয় জানতে চাইলে বিএডিসির এগ্রো সার্ভিস সেন্টারের মহাব্যবস্থাপক ড. মো. ইসবাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের হয়রানি করে। যদি নুরুল আলম এ ধরনের অনিয়ম করে থাকেন তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Source link

Related posts

বাগেরহাটে সুপেয় পানির সংকট, অধিকাংশ পিএসএফ অকেজো

News Desk

পর্যটকে মুখরিত অপরূপা বান্দরবান  

News Desk

বসতঘরের সঙ্গেই সমাহিত হলেন তারা

News Desk

Leave a Comment