পদ্মার ভাঙন: ঘরবাড়ি ছাড়লো গোদাগাড়ীর ১৫০ পরিবার
বাংলাদেশ

পদ্মার ভাঙন: ঘরবাড়ি ছাড়লো গোদাগাড়ীর ১৫০ পরিবার

রাজশাহীতে বিশাল পদ্মা পাড়ি দেওয়ার পর একখণ্ড চর। চর পেরোলেই ভারতীয় সীমানা। প্রায় ৩৬ বর্গকিলোমিটারের এই চরটিই চর আষাড়িয়াদহ। এটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার একটি ইউনিয়ন। প্রতি বছর নদীভাঙনের কারণে এ চরের ভূখণ্ড কমছে। এবারও চারটি গ্রামের কমপক্ষে ৪০ মিটার করে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চর ছেড়েছে কমপক্ষে ১৫০ পরিবার।

চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুদিন আগে পদ্মার পানি বাড়লে ১, ২ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে যায়। তখন অনেকে চর ছেড়ে চলে যান। অনেকে আবার কষ্ট করে পানির মধ্যেই বাস করছিলেন। এখন নদীর পানি অল্প অল্প করে নামছে। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে ভাঙন। এখন আর বাড়িতে থাকার উপায় নেই। ঘরবাড়ি ভেঙে ওইপারে চলে যেতে হচ্ছে।’

জানা গেছে, পদ্মা নদী লাগোয়া হঠাৎপাড়া, চর বয়ারমারি, কামারপাড়া, জামাইপাড়া ও আমতলা খাসমহল গ্রামে ভাঙন চলছে। জামাইপাড়া গ্রামের সাইদুর রহমানের বাড়ির অর্ধেক নদীতে নেমে গেছে। বাকি অর্ধেক ভেঙে নৌকায় তুলছিলেন সাইদুর। তিনি জানালেন, পদ্মার ভাঙনের কবলে এর আগে দুইবার বাড়ি সরিয়েছেন। এবার আর চরে থাকার মতো নিজের জায়গা নেই। তাই বাড়িঘর ভেঙে ওপারে ভাইয়ের বাড়ি চলে যাচ্ছেন।

চর থেকে বাড়িঘর ভেঙে নৌকায় তুলে সেখানকার বাসিন্দারা গোদাগাড়ীর ফুলতলা ঘাটে এসে উঠছেন। সেখানেই কথা হয় হঠাৎপাড়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৫ বছর আগে একবার বাড়ি সরাতে হয়েছিল ভাঙনের কারণে। এবার আর সরিয়ে বাড়ি করার অবস্থা নেই। চম্পকনগর গ্রামে দুই কাঠা জমি কিনেছেন। এবার সেখানে চলে যাচ্ছেন।

জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন খুব বেড়েছে। এই কয়দিনে কমপক্ষে ১৫০ পরিবার এপারে চলে এসেছে। আরও অনেকে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’

কিছুক্ষণ পর বাক্স, দড়ির খাট, টিনের চালা, আলনা, চৌকিসহ পরিবারের ব্যবহার্য সব মালামাল নিয়ে তীরে ভিড়লো আরেকটি নৌকা। নৌকায় ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন বয়রামারি থেকে আসা গৃহবধূ তাহেরা খাতুন।

তিনি বললেন, ‘ছ বছর আগে একবার বাড়ি ভাইঙতে হয়েছিল। এখুন আর অন্য জাগা নাই যে বাড়ি কইরবো। জন্মের থেকেই চরে থাকি, আর থাকা হলো না। এপারের কানাইডাঙ্গা গ্রামে ভাসুরের বাড়ি। সেখানেই চলে যাচ্ছি। ভাসুরের বাড়িতে থাইকবো। জমিটমি দেখে পরে বাড়ি কইরবো।’

চর আষাড়িয়াদহ এলাকায় পদ্মার পানির বিপদসীমা কত, সে তথ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে নেই। তবে রাজশাহী শহরসংলগ্ন এলাকায় পানির বিপদসীমা ১৮ দশমিক ০৫ মিটার। এখানে প্রতিদিন পানির উচ্চতা পরিমাপ করা হয়। সম্প্রতি এখানে পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা হয়েছিল ১৭ দশমিক ৪৯ মিটার। তারপর পানি কমছে। শনিবার দুপুরে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৮৫ মিটার। এখনও চরের অনেক এলাকাই তলিয়ে আছে।

চর আষাড়িয়াদহ ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চরের মানুষ খুব অসহায় অবস্থায় আছি। সাহায্য-সহায়তা তেমন পাইনি। ১০ কেজি করে চাল দিতে পেরেছি। যার বাড়ি ভেঙে চলে যেতে হচ্ছে, তার কাছে ১০ কেজি চাল কিছুই না। সরকারকে এই মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। পাশাপাশি চরটাকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে প্রতি বছর যেভাবে চর ভাঙছে, একসময় এটা মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। নদী ঢুকে যাবে ভারতে।’

গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘পানি বৃদ্ধির শুরুতে ২০টি পরিবার ভাঙনের কবলে পড়ে চর ছেড়েছিল। পানি কমার সময় এ সংখ্যা ৯০টি। সবমিলিয়ে ১১০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত বলে আমার কাছে তথ্য আছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ঢেউটিন সহায়তা দেওয়া হবে।’

অন্যদিকে, রাজশাহীর বাঘায় পদ্মার চকরাজাপুর চরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন সোবহান মণ্ডলের পরিবার। পদ্মা থেকে প্রায় সিকি কিলোমিটার দূরে জমি ভাড়া নিয়ে সোবহান গত বছর বাড়ি করেছিলেন। পদ্মা ভাঙতে ভাঙতে এবার বাড়িটির ধারে এসেছে। যেকোনও সময়ে পদ্মাগর্ভে চলে যাবে। যাওয়ার কোনও জায়গা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারটি সেখানে বসবাস করছে।

জানা গেছে, সোবহান মণ্ডল ৫০ বছর আগে বর্তমান বাড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে প্রথম বাড়ি করেন। সেখানে কয়েক বছর বসবাস করার পর বাড়িটি ভাঙনে চলে যায়। পরে সেখান থেকে তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে জমি কিনে বাড়ি করে সেখানেও ভাঙন থেকে টিকতে পারেনি। এখান থেকে আবারও চার কিলোমিটার পূর্ব দিকে জমি কিনে বাড়ি করলেও ভাঙনে তাদের সমস্ত বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের শেষের দিকে কোয়ার্টার কিলোমিটার পূর্বে চকরাজাপুর হাই স্কুলের দক্ষিণে ৫ কাঠা জমি বছরে ৫ হাজার টাকা চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখানেও পদ্মার ভাঙন বাড়ির কাছে চলে এসেছে। যেকোনও সময় পদ্মাগর্ভে চলে যাবে।

সোবহান মণ্ডলের স্ত্রী হাসেনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘদিন থেকে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে ঘরে পড়ে আছে। কেউ কোনও সহযোগিতা করে না। ছেলে হাসিনুর রহমান পদ্মায় মাছ ধরে যা পায়, তা বিক্রি করে যা হয়, তা দিয়ে কোনোমতে একবেলা খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করি।’

আরেক ভাঙনকবলিত মৎস্যজীবী হাসিনুর রহমানের বড় ছেলে মানিক চকরাজাপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে জেসমিন নবম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে নাসরিন একই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে।

হাসিনুর রহমানের স্ত্রী জয়গন বেগম বলেন, ‘একজনের আয় দিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্ট হয়। নদীতে সব সময় মাছ পাওয়া যায় না। অসুস্থ শ্বশুর ও বৃদ্ধা শাশুড়ি এবং তিন সন্তানের লেখাপড়া করাতে হিমশিম খেতে হয়। টাকার অভাবে শ্বশুরের চিকিৎসা করাতে পারছি না। এদিকে নদীর ভাঙন বাড়ির ধারে-কাছে চলে এসেছে। রাতে ঘরে ঘুমিয়ে শান্তি পাই না। যেকোনও সময়ে পদ্মাগর্ভে চলে যাবে। ঘরে ধারির নিচে ৫০ ফুট গভীর।’

এ ছাড়া ওই এলাকায় ঝুঁকিতে রয়েছে জয়নাল হোসেন, আজিজুর রহমান, সাইম হোসেন, নয়ন আলী, শহিদুল ইসলাম, মাহাবুল হোসেনের পরিবার।

এ বিষয়ে বাঘা চকরাজাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুল আযম বলেন, ‘সোবহান মণ্ডলের মতো শতাধিক পরিবার ঝুঁকিতে বসবাস করছে। পদ্মার পানি কমে যাওয়ার পর নতুন করে আবারও পানি বাড়তে শুরু করেছে। এ পানি অনেকের উঠানে উঠেছে। তারা খুব কষ্টে ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।’

বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাম্মী আক্তার বলেন, ‘পদ্মায় আবার নতুনভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অবগত হয়েছি।’

Source link

Related posts

ভয়ানক মাদক আইস সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ আটক ৬

News Desk

বাংলাদেশ জাতিসংঘের তিন সংস্থার নির্বাহী বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত

News Desk

ফরিদপুরে বরাদ্দ টিকা শেষ, টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ

News Desk

Leave a Comment