দূষণে ভালো নেই ধলেশ্বরী, পানির রঙ এখন কালো
বাংলাদেশ

দূষণে ভালো নেই ধলেশ্বরী, পানির রঙ এখন কালো

মারাত্মক দূষণে অস্তিত্ব সংকটে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী। যে নদীর পানি এক সময় স্থানীয়রা নির্দ্বিধায় দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতো সেই স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী এখন দূষণে বিবর্ণ। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, দূষণ রোধের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদফতরের। আর পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা বলছেন, দূষণ রোধে তারা কাজ অব্যাহত রেখেছেন।

মুন্সীগঞ্জ শহরের কোল ঘেঁষে প্রবাহিত ধলেশ্বরী নদী এখন মৃতপ্রায়। পানি পচে কালো রঙ ধারণ করেছে। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। বিশেষ করে মীরকাদিম নৌবন্দর এলাকা থেকে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট পর্যন্ত দূষণে নদীর অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। শহরের নোংরা, আবর্জনা ও পৌরসভার ড্রেনের পানি সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। আর কল-কারখানার বর্জ্যে ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে নদীর পানি।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. শাকিব জানান, আমাদের প্রাণের ধলেশ্বরী নদী আজকে দূষিত হয়ে একেবারে কালো হয়ে যাচ্ছে। যে নদীর পানি স্বচ্ছ ছিল, রান্নার কাজ চলতো, প্রাণভরে সাঁতার কেটে গোসল করা যেতো, আজ সে নদীর পানি দুর্গন্ধে ভরা। নদীর তীরে কিছুক্ষণও দাঁড়ানো যায় না। তিনি বলেন, এই ধলেশ্বরী নদীতে এক সময় অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। আমরা এখানে এসে মাছ ধরতাম। কিন্তু সেই ধলেশ্বরী এখন আর নেই। মুন্সীগঞ্জে অনেক ফল ব্যবসায়ীর অবিক্রিত বাঙ্গি, তরমুজ, বিভিন্ন ফলের খোসা, ফলের বিভিন্ন বর্জ্য নদীর তীরে ফেলে। এমনকি যারা বাসাবাড়িতে কাজ করে তাদের বাসার সমস্ত ময়লা এনে এই ধলেশ্বরীতে ফেলে।

আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা অর্ণব চক্রবর্তী জানান, আমাদের মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী এখন মরে গেছে। এই নদীর পানি বুড়িগঙ্গার চাইতেও খারাপ অবস্থায়। এর একটাই কারণ, নদীর দুই তীরে থাকা বিভিন্ন শিল্প ও কল-কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। সারা শহরের ময়লা-আবর্জনা সবকিছু এই নদীতে এসে পড়ে। নদী সংরক্ষণে কোনও ব্যবস্থাপনাই নেই। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এই মুহূর্তে ধলেশ্বরী সংরক্ষণের কোনও উপায় নেই।

হাটলক্ষীগঞ্জের সফি মোল্লা জানান, আমাদের ধলেশ্বরী নদীর পরিবেশ এখন খুবই খারাপ। আগে এই নদীতে আমরা গোসল করতাম, এমনকি নদীর পানি দিয়ে বাসাবাড়িতে রান্নাবান্নার কাজও করা হতো। এখন নদীর যে অবস্থা, বুড়িগঙ্গার চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট ধলেশ্বরী নদীর পানি। মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার ড্রেনের বর্জ্য এসে সরাসরি নামছে নদীতে। আর এই নদীর তীরও দখলে হয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখার কেউ নেই। আমরা কার কাছে গিয়ে এই কথা বলবো? আমাদের এই নদীকে আপনারা বাঁচান। যাদেরকে বলি, তারাই বলে— দেখছি। এটি বলেই শেষ। তারপর আর কোনও খোঁজ থাকে না। আমরা চাই যে কোনও উপায়ে এই নদীর পূর্ব রূপ ফিরে আসুক। এই নদীর পানি যেন আগের মতো ব্যবহার করতে পারি।

বাগমামুদালী এলাকার শোভন হাসান জানান, আমরা ছোটবেলা থেকে এই নদীতে গোসল করতাম। তখন নদীর পানি খুব পরিষ্কার ছিল। কিন্তু বিগত ৬-৭ বছর ধরে এই নদীতে ময়লা–আবর্জনা, কল-কারখানার রাসায়নিক পদার্থ মিশে পানির মান নষ্ট করে ফেলেছে। আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যাতে এই ধলেশ্বরী নদী আবার আগের রূপে ফিরিয়ে আনা হয়। এছাড়া নদীর দুই তীরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা ধলেশ্বরীকে বেশি দূষিত করছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। এতে ধলেশ্বরী হারিয়েছে তার রূপ-বৈচিত্র্য ও জৌলুস।

শহরের ময়লা-আবর্জনা দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীর পানি

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), মুন্সীগঞ্জ সভাপতি অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা নদীর পাড়ে ইটিপি (তরল বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট) ছাড়া সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালায়, কারখানা চালায়, নদীতে বর্জ্য ফেলে তারাই নদী দূষণ করছে। তিন বলেন, এই নদী দখল-দূষণ করার জন্য নানান প্রভাব খাটানোর ফলে টাকার বিনিময়ে প্রভাবশালীরা ধলেশ্বরী নদীকে সরু করে ফেলেছে। নদী দূষণ হওয়া মানে পরিবেশ দূষণ হওয়া। জেলার পরিবেশ বাঁচাতে উচিৎ দ্রুত পদক্ষেপ হাতে নেওয়া। নদী না বাঁচাতে পারলে আমরাও বাঁচবো না। নদী দূষণ বন্ধ না করা মানে আমাদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা।

মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নদীর সীমানা রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। দূষণ রোধে কাজ করে পরিবেশ অধিদফতর।

শিল্প কারখানাগুলোর ইটিপি প্লান্ট ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। আইন অমান্য করলে জরিমানা করা হয় বলে জানান মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জ এলাকার ভিতরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, মদিনা, আইডিয়াল, বর্ণালী এই তিনটা প্রতিষ্ঠানের ইটিপি আছে এবং তারা যথাযথভাবে ইটিপি পরিচালনা করছে কিনা নিয়মিত মনিটরিং করছি। ইতোমধ্যে একদিন ইটিপির পরিচালনা বন্ধ পেয়ে তাদেরকে জরিমানার আওতায় আনা হয়েছে। তারা যাতে সঠিকভাবে ইটিপি পরিচালনা করে এজন্য তাদেরকে আইপি ক্যামেরা বসাতে বলা হয়েছে। সবার ক্যামেরা বসানো আছে। তারপরও আমরা যদি কোনও ত্রুটি পাই তাহলে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনি। কয়েকদিন আগে মেঘনা শাখা নদীর পাশে অবস্থিত বসুন্ধরা কারখানাকে যথাযথ ইটিপি পরিচালনা না করায় ১৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

নদীতে ময়লা–আবর্জনা, কল-কারখানার রাসায়নিক পদার্থ মিশে পানির মান নষ্ট করে ফেলেছে

তিনি আরও বলেন,  শুধু আইন দিয়ে হবে না, আমাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে। কারণ এই মুন্সীগঞ্জে দেখা যাচ্ছে নদীর পাড়ে বসতবাড়ি থাকে। আমরা বুঝে না বুঝে অথবা অসচেতনতাবশত আমাদের বাসাবাড়ি ময়লাও নদীতে ফেলি। আসলে প্রকৃত অর্থে আমাদের সচেতনতা দরকার। পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলে আমরা সবাই অস্তিত্বহীনতায় ভুগবো বলে জানান তিনি।

শুধু কাগজে-কলমে বা কথায় সীমাবদ্ধ না থেকে ধলেশ্বরী নদী রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।

Source link

Related posts

তিস্তার ‘ঘোলা পানি’ হাসি ফোটাচ্ছে চরের কৃষকের

News Desk

রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে আরও ২২ জনের মৃত্যু

News Desk

ভিডিওর পর ছাড়ার হুমকি, হাতিয়ে নিতো মোটা অঙ্কের টাকা

News Desk

Leave a Comment