বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) খুলনা কার্যালয়ের অফিস সহকারী নিজাম উদ্দিন গাজী। তার মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে মেজো ছেলে মো. খলিলুর রহমান পোষ্য কোটায় পিএসসিতে ডেসপাস রাইডার পদে চাকরি পান। কিন্তু পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় খলিল গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে এখন তার মাকে লজ্জায় মুখ লুকাতে হচ্ছে। তবে বিষয়টি এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার মা এবং স্বজনদের।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খলিলুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট ইউনিয়নের পাচারই গ্রামে। তবে বাবার কর্মস্থল সূত্রে খলিলুর বড় হয়েছেন খুলনা মহানগরীর রায়ের মহল খালপাড় মোল্লাপাড়া এলাকায়। এখানে বাড়ি থাকলেও চাকরির কারণে খলিলুর ঢাকায় থাকেন। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে খলিল মেজো।
শনিবার দুপুরে মোল্লাপাড়া এলাকার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির প্রধান ফটকে ভেতর থেকে তালা দেওয়া। আধাঘণ্টা ধরে ডেকেও কারও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। বাড়ির টিনের বেড়ার ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে কোনও মানুষের দেখা মেলেনি। তবে ভেতরে একতলা দুটি বাড়ি দেখা যায়।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একতলা নতুন বাড়িটি করেছেন খলিলুর। পুরোনো একতলা বাড়িটি তার বাবা নিজাম উদ্দিনের করা। নিজাম এখানেই বিয়ে করেছেন। শ্বশুরের দেওয়া জমিতে বাড়ি করেছেন। তবে চাকরি হওয়ার পর থেকে খলিল এখানে মাঝেমধ্যে আসতেন। বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকতেন।
নিজাম উদ্দিনের পরিবারকে প্রায় ৩০ বছর ধরে চেনেন খুলনার নূরনগর ওয়াপদা মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মিজানুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিজাম মুক্তিযুদ্ধের আগে যশোরের রাজনীতিবিদ মশিউর রহমানের বাড়িতে গৃহ-সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর হাতে মশিউর শহীদ হন। দেশ স্বাধীনের পর মশিউরের স্ত্রী অধ্যাপক মাহমুদা রহমান পিএসসির সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। মূলত তার সুবাদেই পিএসসিতে চাকরি হয় নিজামের। আমি যখন খুলনার আযম খান কলেজে পড়ি তখন নিজাম খুলনায় পিএসসি অফিসে চাকরি করতেন। ছয় বছর আগে মারা গেছেন নিজাম। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুর পরে পোষ্য কোটায় খলিল চাকরি পান। ছাত্র থাকা অবস্থায় লেখাপড়ায় ভালো ছিলো না খলিল। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় খলিল গ্রেফতারের কথা শুনে তার মা ও আমরা লজ্জায় পড়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পোষ্য কোটায় খলিরের চাকরি হওয়ার পরের বছর বড় ভাই হাবিবুর রহমানও একই কোটায় একই প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে চাকরি পেয়েছেন। তিনি এখন ওই পদে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ২০১২ সালে গ্রেফতার হন খলিল। তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছিল। এর পরের বছর বরখাস্ত হন। দীর্ঘ ১০ বছর পর ২০২২ সালে চাকরি ফিরে পান।
মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা মফিজ মোল্লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শ্বশুর পক্ষ থেকে নিজাম উদ্দিন ১৫ শতক জমি পান। সেখানে একতলা ভবন ছিল। ওখানে সম্প্রতি খলিল চার কক্ষের একতলা বাড়ি করেন। তবে ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। বাড়িটি ভাড়া দেওয়ার কথা চলছিল।’
একই এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘খলিল এখানে তেমন একটা আসেন না। ঢাকায় থাকেন। স্থানীয় অনেকে খলিলের কাছে চাকরির জন্য টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে শুনেছি।’
এমন ঘটনায় লজ্জায় মানুষকে মুখ দেখাতে পারি না উল্লেখ করে খলিলের মা রোকসানা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খলিল পোষ্য কোটায় ২০০৮ সালে চাকরি পায়। পরের বছর একই কোটায় পিএসসিতে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে তার বড় ভাইয়ের চাকরি হয়। গ্রেফতারের পর থেকে শুনতেছি, তার নাকি ঢাকায় ফ্ল্যাট ও গাড়ি আছে। কিন্তু গ্রামে তো কিছুই করেনি। এই বাড়িটি তার বাবা করে গেছেন। এখানে খলিলের কিছু নেই। চাকরি হওয়ার পর থেকে এখানে ঠিকমতো আসতো না। আমাদের খোঁজখবরও নিতো না।’
খলিলের ভাবি ফাতেমা বেগম বলেন, ‘খলিল পাঁচ বছর আগে দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রামে বিয়ে করেছে। তার কোনও সন্তান নেই। কোরবানির ঈদে বাড়িতে এসেছিল। এ ছাড়া তেমন একটা আসে না।’
খলিলুর রহমানের পৈতৃক বাড়িতে কী আছে
কেশবপুর শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে পাচারই গ্রাম। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ খলিলুর রহমানকে চেনেন না। তবে পিএসসির প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়ার পর নামটি শুনেছেন। ঘাঘা উত্তরপাড়া জামে মসজিদের ঠিক উল্টো পাশে পৈতৃক বাড়িটি। এখানে বসবাস করেন তার চাচা নিছার আলী গাজী। সর্বশেষ দুই বছর আগে এখানে এসেছিলেন। প্রায় ১০ শতক জায়গার ওপরে ভাঙাচোরা টিনের ঘর। সঙ্গে লাগোয়া টিনের বেড়ার ওপর দিয়ে ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর। ঘরের উল্টো পাশে গোয়ালঘর।
নিছার আলী গাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে ৪১ শতাংশ জমি আছে। এর মধ্যে বসতবাড়ি ১০ শতাংশের ওপর, কারখানা পাঁচ শতাংশে এবং বাকি অংশ পুকুর। এ ছাড়া মাঠে কৃষিজমি আছে ৪৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে আমাদের পৈতৃক জমি দুই বিঘা। আমরা তিন ভাই ও তিন বোন। নিজাম আমাদের বড় ভাই। তার ছেলে খলিল। ছয় বছর আগে মারা গেছেন নিজাম। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ভাই এখানে কোনও মতে আছি। কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। তবে আমাদের পৈতৃক জমি এখনও ভাগ হয়নি। হলে খলিলরাও পাবে। খলিল দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে বাবার কোটায় পিএসসিতে চাকরি পেয়েছিল। তবে এখানে আসে না। তারা খুলনায় থাকে। তার মাও খুলনায় থাকেন।’
আমার বড় ভাই অত্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন উল্লেখ করে নিছার আলী বলেন, ‘রাজনীতিবিদ মশিউর রহমানের বাড়িতে থাকতেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা পদবি নেননি। অল্প শিক্ষিত হলেও দেশ স্বাধীনের পর সততার কারণে পিএসসিতে চাকরি পান।’
নিছার আলী আরও বলেন, ‘খলিল এমন দুর্নীতি করতে পারে এটা আমার বিশ্বাস হয় না। ওর আচার-আচরণে কখনও বোঝা যায়নি। দুই বছর আগে একবার বেড়াতে এসেছিল। অল্প সময় থেকে আবার চলে যায়। কেবল ওর দাদি মারা যাওয়ার সময় তিন-চার ঘণ্টা বাড়িতে ছিল। সব সময় মাকে নিয়ে খুলনার বাসায় থাকতো। যদি সে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে তদন্ত করে যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা নিলে আমার আপত্তি নেই।’
খলিলের চাচি পারুল বেগম বলেন, ‘আশপাশের মানুষ বলছে খলিলকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পুলিশ ধরেছে। এর আগে কিছুই জানতাম না। এই খবর শোনার পর থেকে গলা দিয়ে ভাত নামছে না। খলিল অনেক ভালো ছেলে। ওকে আমি নিজের ছেলের মতো দেখি। আল্লাহ জানে কীভাবে কী হলো। ভালোমন্দ কিছুই জানি না।’
খলিলের প্রতিবেশী কৃষক জাকির হোসেন বলেন, ‘ছয় বছর আগে খলিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। খুব কমই আসে গ্রামে। তাকে ও তার বাবাকে যতটুকু জানি, তারা ভালো মানুষ।’
খলিলের বিষয়ে কথা হয় মঙ্গলকোট ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মোসলেম উদ্দিন গোলদারের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খলিলকে আমি ভালোভাবে চিনি না। তবে তার বাবা সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেহেতু খলিল এখানে থাকে না, শুনেছি খুলনায় থাকে, সে কারণে এখানকার মানুষ খুব একটা চেনে না। সম্প্রতি প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় তার কথা এলাকায় শোনা যাচ্ছে।’
মঙ্গলকোট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের বিশ্বাস বলেন, ‘খলিলকে আমি চিনি না। তার বাড়ি যে এখানে তাও জানতাম না। গ্রেফতারের পর থেকে শুনছি, আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা।’

