কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের দারিদ্র্য হ্রাসকরণের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ২০২২-২৩ থেকে ২০২৪-২৫ তিন অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪১ কোটি চার লাখ টাকা। ‘কফি ও কাজুবাদাম প্রকল্প’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকে এসব অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পে দুর্নীতি করে যার বেশিরভাগ অর্থ নিজের পকেটে নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. জসিম উদ্দিন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তিন অর্থবছরের মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধুমাত্র বান্দরবানে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক কৃষককে কফি ও কাজুবাদামের উন্নতজাতের বীজসহ নানা সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও শুধুমাত্র নিম্নমানের অপরিপক্ব কিছু চারা দিয়ে দায় সেরেছেন প্রকল্প পরিচালক। এসব কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতেই মাটিতে মিশে গেলো বেশিরভাগ কৃষকের স্বপ্ন। পাহাড়ি এলাকা দুর্গম ও যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় এখানে তদারকির সুযোগও কম। এ সুযোগে কৃষকদের সুবিধা না দিয়ে প্রকল্পের বেশিরভাগ টাকা নিজের পকেটে নিয়েছেন পরিচালক।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রকল্পের মাধ্যমে কফি ও কাজুবাদাম সম্পর্কে দক্ষতা অর্জনের জন্য কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ সভা ও ভ্রমণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, উন্নতজাতের কফি ও কাজুবাদামের বীজ/চারা আমদানি, বাগানের জন্য সার, কীটনাশক, চারা তৈরির জন্য নার্সারি স্থাপন, বাগানের রোপণ সামগ্রী, প্রতিটি বাগানে বেড়া তৈরি, পানির উৎস সৃষ্টির লক্ষ্যে বাঁধ নির্মাণ, ড্রিপ ইরিগেশন, পানির ট্যাংক স্থাপনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ, কফি প্রক্রিয়াকরণ মেশিন, কাজুবাদাম প্রক্রিয়াকরণ মেশিনসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ সরবরাহসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা। যার কিছুই করা হয়নি। শুধুমাত্র দেখানোর জন্য জেলা শহর, বিভিন্ন উপজেলার সড়কের আশপাশে কফি ও কাজুবাদাম প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন প্রকল্প পরিচালক। কাগজ-কলমের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সীমাবদ্ধ রেখে বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে জানাজানি হলে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে এসব অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন।
প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়িত কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, সঠিক সময়ে চারা ও বীজ না দিয়ে অসময়ে দেওয়ায় তা রোপণ করার পর মরে গেছে। বান্দরবানের কৃষকদের জন্য ৯২টি পানির ট্যাংক বরাদ্দ থাকলেও দেওয়া হয়েছে ১২টি। এগুলো দেওয়া হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের সময় যেন প্রদর্শন করা যায়, এমন জায়গায়। আবার ৯২টি পানির ট্যাংক স্থাপনে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোথাও অবকাঠমো তৈরি করা হয়নি। কাগজ-কলমে কাজের বাস্তবায়ন দেখিয়ে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। একইভাবে বাগানে বেড়া দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়নি। কফি ও কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য দুটি মেশিন দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়নি। যেসব এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে বর্তমানে সেখানের কৃষকরা জুম চাষসহ নানা প্রকার সবজি চাষ করেছেন। কোটি কোটি টাকা বরাদ্দের পরও কফি ও কাজুবাদামে কোনও সফলতা না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, প্রতি অর্থবছরে অসময়ে কিছু নিম্নমানের চারা দেওয়া হয়েছে কফি ও কাজুবাদামের। তবে কোনও উপকরণ দেয়নি। ফলে অনেক চেষ্টা করেও চারা বাঁচাতে পারেননি। এগুলো চাষে অনেক সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও কিছুই দেয়নি কৃষি অফিস। শুধু লোক দেখানোর জন্য কিছু চারা দেওয়া হয়েছে।
রুমার বটতলী পাড়ার কৃষক ক্যাসা মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় ২১ জন কৃষক আছে। তাদের বাগানগুলো একটু দুর্গম এলাকায়। তাই তাদের কোনও ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমার বাগানটিতে যাতায়াতের সুবিধা থাকায় কিছু চারা দেওয়া হয়। সেগুলো দেখতে ইতিমধ্যে ১০-১৫ বার পরিদর্শন করেছেন কর্মকর্তারা। অথচ অন্য বাগানগুলোতে কেউ যায় না, সেগুলোর কোনও খবর নেয় না। কারণ তাদের বাগানের সবগুলো চারা মরে গেছে। এখন জুম ও সবজি চাষ করেছেন তারা।’
একই পাড়ার মংক্য মারমা বলেন, ‘কফি ও কাজুবাদাম প্রকল্প কৃষকদের উন্নয়নের জন্য দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে দুর্নীতিবাজ কর্তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। তারা আমাদের কোনও ধরনের সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে প্রকল্পের সব অর্থ নিজেদের পকেটে ভরেছেন। আবার এগুলো দেখারও কেউ নেই।’
রুমা উপজেলার ময়ুর পাড়ায় কফি ও কাজুবাদাম চাষি মুইক্য চিং মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাকে কফি ও কাজুবাদামের কিছু চারা দিয়েছে অসময়ে। যে সময়ে চারাগুলো দিয়েছে তখন বর্ষাকাল শেষ। পানির ব্যবস্থাও করে দেয়নি। তাই চারাগুলো চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি। প্রতি বছর আমাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য প্রকল্প দেয় সরকার। অথচ সেগুলো যথাযথভাবে আমাদের না দিয়ে প্রকল্পের অর্থ লুটপাট করেন কর্মকর্তারা।’
একই অভিযোগ করেছেন ময়ুর পাড়ায় কফি ও কাজুবাদাম চাষি আচমং মারমা। তিনি বলেন, ‘অসময়ে কিছু চারা দিয়েছিল। পরে সেগুলো মরে যায়। এখন দেখি, কর্মকর্তারা শুধুমাত্র রাস্তার পাশে থাকা দুই একটি বাগান দেখে ওখানেই ছবি তুলে চলে যান। আমাদের বাগান দেখতে চান না, আসেনও না। যদি দুর্গম এলাকায় তদারকি সম্ভব না হয়, তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করাই ভালো। অন্তত প্রকল্পের নামে অর্থ লোপাট হবে না।’
একই অবস্থা দেখা গেছে রোয়াংছড়ি উপজেলার প্লেদয় পাড়ার খামচিয়াং ম্রোর বাগানে গিয়ে। তার বাগানের সব চারা মরে গেছে। তিনি বলেন, ‘চারাগুলো ছিল ছোট। এগুলো লাগানোর পরপরই মরে গেছে। কয়েকটা কিছুদিন বাঁচলেও অনেক যত্ন করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। এখন বাগানে জঙ্গল ছাড়া কিছুই নেই।’
প্লেদয় পাড়ার মেনপয় ম্রো বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় সব মিলিয়ে এক হাজার টাকার চারাও দেওয়া হয়নি। উল্টো এগুলো লাগিয়ে আমরা বিপদে পড়েছি। চারা লাগালে আমাদের যেসব সুবিধা দেবে বলেছিল, আমরা তার কিছুই পাইনি। এখন আমরা কফি ও কাজুবাদামের জমিতে জুম চাষ করেছি।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রুমা ও রোয়াংছড়িতে বাগান দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মাঠকর্মী অংথুই চিং মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৯২টি পানির ট্যাংক দেওয়ার কথা থাকলেও আমাকে দিয়েছে ১২টি। এগুলো রাস্তার পাশে অর্থাৎ যেখানে দিলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখে পড়ে, সেখানে দিতে বলেছেন প্রকল্প পরিচালক। আমিও পরিচালকের কথামতো ১২টি পানির ট্যাংক রাস্তার পাশে দিয়েছি।’
কফি ও কাজুবাদাম প্রকল্পের টাকা লুটপাটের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক আমাকে যেভাবে কাজ করতে বলেছেন, আমি সেভাবে করেছি। লুটপাটের দায় আমার নয়।’
এদিকে, প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার এলাকায় অনেক কফি ও কাজুবাদামের বাগান আছে। তবে এগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন। উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা এসে কৃষকদের সঙ্গে গোপনে কী যেন আলাপ করে চলে যেতেন। আমি কয়েকবার জানতে চাইলেও কিছু বলেননি। ফলে উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া কফি ও কাজুবাদাম বাগান প্রকল্পের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আগেও তাদের বরাদ্দের সরকারি কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এখনও করা হয়েছে। অবশ্যই এগুলো তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
একই কথা বললেন রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহ্লা অং মারমা। তিনি বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে জানামতে উন্নয়ন বোর্ড থেকে একটি মিশ্র ফলের বাগান করে দেওয়া হয়েছিল অনেক আগে। কফি ও কাজুবাদাম প্রকল্প সম্পর্কে আমি কখনও কিছু শুনি নাই। আমাদের না জানিয়ে উন্নয়ন বোর্ড কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তাও জানি না। এগুলো তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
এ ব্যাপারে বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক এম.এম শাহ নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের প্রচুর জনবল থাকার পরও কৃষি বিভাগের উৎপাদিত চারা রক্ষা করতে পারি না। প্রতিনিয়ত মাঠকর্মীরা তদারকি করেও সফলতা আনতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের জনবল না থাকার পর কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সফলতা আনবে, তা আমার জানা নাই। জনবল ও তদারকি ছাড়া কোনোভাবেই এখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জনবল না থাকলে সঠিকভাবে চারা এবং সরঞ্জাম বিতরণও সম্ভব নয়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের কফি ও কাজুবাদাম প্রকল্পের পরিচালক জসিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা ত্রুটি হয়েছে। সঠিক সময়ে অনেক কিছু দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই বরাদ্দের কিছু টাকা ফেরতও পাঠিয়েছি। তবে কোন অর্থবছরে কোন খাতের কত টাকা ফেরত পাঠিয়েছি, তা এখন বলতে পারবো না। সামনে কফি ও কাজুবাদামের নতুন প্রকল্প আসছে। এটি বাস্তবায়িত হলে কৃষকদের ভাগ্য ফিরবে। তবে প্রকল্পটিতে দুর্নীতি ও অর্থ লোপাট হয়নি। মাঠপর্যায়ে কিছু সমস্যা তো আছেই। তবে আপনার নেতিবাচক রিপোর্টের কারণে আসন্ন প্রকল্পটি বাতিল হয়ে গেলে কৃষকদেরই ক্ষতি হবে।’