Image default
বাংলাদেশ

গ্রাহকের আগ্রহ প্রিপেইড মিটারে, কম্পানির নেই

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী কামাল হোসাইন গত বছরের আগস্টে বাসায় প্রিপেইড গ্যাস মিটার পেয়েছেন। তিনি থাকেন রাজধানীর ভাটারায়। চারজনের পরিবার তাঁর। আগে দুই চুলার জন্য প্রতি মাসে বিল দিতেন ৯৭৫ টাকা।

প্রিপেইড মিটারে মাসে তাঁর খরচ হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। প্রতি মাসে তাঁর অন্তত ৪২৫ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, শতকরা হিসাবে যা প্রায় ৪৩ শতাংশ। 

বাসাবাড়িতে গ্যাসের এই প্রিপেইড মিটার স্থাপন শুরু হয় ২০১৭ সালে। যদিও পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। শুরুতে সরকারের গ্যাস বিতরণ কম্পানিগুলোর বেশ আগ্রহ ছিল মিটার স্থাপনে। কিন্তু আস্তে আস্তে মিটার স্থাপনে দীর্ঘসূত্রতা শুরু হয়। এখন আবেদন করেও মিটার পান না গ্রাহক। যদিও প্রিপেইড মিটারে গ্যাসের অপচয় রোধ, গ্রাহকের খরচ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রায় প্রতিষ্ঠিত।

এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মিটার বসানোর পর কম্পানিগুলো বুঝতে পারে, প্রথাগত বিলিং ব্যবস্থার চেয়ে প্রিপেইড মিটারে তাদের আয় কমে যাবে। প্রিপেইড মিটার প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্দেশ ছিল, দ্রুত সব গ্রাহকে প্রিপেইড মিটারের আওতায় নিয়ে আসা। দেশে ছয়টি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা ৪৩ লাখ। ছয় বছরে মাত্র দুটি গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান চার লাখের মতো গ্রাহককে প্রিপেইড সুবিধা দিয়েছে। বাকি ৯০ শতাংশের বেশি গ্রাহক এই সুবিধার বাইরে আছে। এ হিসাবে বিতরণ কম্পানিগুলো প্রতি মাসে ৩৯ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ১৬৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বেশি বিল হিসেবে আদায় করছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দুই চুলায় মাসে ৭৭ ঘনমিটার গ্যাসের ব্যবহার ধরে দাম নির্ধারণ করে। তাতে ৯৭৫ টাকা বিল নেয় বিতরণ কম্পানি। কিন্তু জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই চুলার একজন গ্রাহক মাসে গড়ে ৪০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন, যার দাম আসে ৫০৬ টাকা। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের হিসাবের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের হিসাবের মিল পাওয়া যায়।

প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গুলশান কালাচাঁদপুর এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রিপেইড মিটারের কারণে আমার মাসে প্রায় ৫০০ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। এক হাজার টাকা রিচার্জ করলে দুই মাস ব্যবহার করতে পারি। এই টাকার মধ্যেই মিটারের ভাড়া ও ভ্যাটও আছে। এর আগে দুই চুলায় আমার মাসে খরচ হতো ৯৭৫ টাকা। ’

একাধিক গ্রাহক জানান, একসময় বিভিন্ন এলাকায় তিতাস গ্যাসের স্থানীয় কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রিপেইড মিটার বসানোর তাগাদা দিয়েছেন। মিটারের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়া হতো না। কিন্তু শুরুতে অনেকেই আগ্রহী হননি। এখন বেশির ভাগ গ্রাহক প্রিপেইড মিটারে আগ্রহী। কিন্তু বিতরণ কম্পানিগুলোতে আবেদনের পর কয়েক বছর অপক্ষো করেও মিটার পাচ্ছেন না।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্যাস বিতরণকারী কম্পানিগুলো আবাসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে এখন যে রাজস্ব পাচ্ছে, প্রিপেইড মিটার বসানো হলে তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ রাজস্ব কমে যাবে। কারণ আবাসিকে গ্যাসের দাম নির্ধারণকালে যে পরিমাণ গ্যাস ধরা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম গ্যাস ব্যবহার করেন গ্রাহক। ’

২০১১ সালে পরীক্ষামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির ২৮ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৭ আবাসিক গ্রাহক আছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত তিন লাখ ২০ হাজার প্রিপেইড মিটার পেয়েছেন। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), সরকার ও টিজিটিডিসিএলের অর্থায়নে এই প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়।

জানতে চাইলে তিতাসের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক মির্জা মাহবুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের আরো ১২ লাখ মিটার বসানোর জন্য দুটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ’ গত বছরও প্রিপেইড মিটার নিয়ে কালের কণ্ঠের প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রায় এই কথাই বলেছিলেন।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড। তাদের পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৫ জন গ্রাহকের মাত্র ৬০ হাজার জন প্রিপেইড মিটার পেয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রিপেইড মিটার প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আরো এক লাখ মিটার বসানোর আরেকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

সিলেট বিভাগে গ্যাস বিতরণ করছে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির আবাসিক গ্রাহক আছে দুই লাখ ১৯ হাজার ৭৭৫ জন। এই প্রতিষ্ঠান প্রিপেইড মিটার বসানোর জন্য মাত্র প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

ছয়টি গ্যাস বিতরণ কম্পানির বাকি তিনটি এখনো প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কার্যক্রমই শুরু করেনি। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পূর্বঞ্চলে গ্যাস সরবরাহকারী বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের চার লাখ ৮৮ হাজার ৬১ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানি লিমিটেডের আবাসিক গ্রাহক এক লাখ ২৮ হাজার ৮৪৬ জন। খুলনা ও বরিশাল বিভাগে গ্যাস সরবরাহ করছে সুন্দরবন গ্যাস কম্পানি লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের আবাসিক গ্রাহক দুই হাজার ৩৭২ জন।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চাচ্ছিলাম আগামী দুই বছরের মধ্যে অন্তত ১০ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করতে। এতে গ্রাহকেরও সুবিধা হবে, গ্যাসও সাশ্রয় হবে। কিন্তু বিতরণকারী কম্পানিগুলোর খুবই অনীহা প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপনে। ’ তিনি বলেন, ‘তিতাসের বিল দেওয়া ও বিল নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল বড় কারচুপি পাওয়া যাচ্ছে। নিরীক্ষায় (অডিট) এসব কারচুপি বের হচ্ছে। প্রিপেইড মিটারে এসব কারচুপি করার সুযোগ নেই। এ কারণেই তাদের এত অনীহা। ’

Related posts

পেটের দায়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ

News Desk

২৫ দিন পর বাসভবন থেকে বের হলেন শাবিপ্রবি উপাচার্য

News Desk

রাজশাহী মেডিক্যাল করোনা ওয়ার্ডের মেঝেতেও রোগী

News Desk

Leave a Comment