রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার চরাঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ানো ‘কাকন বাহিনী’র ২১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবিবার (৯ নভেম্বর) ভোররাত থেকে রাজশাহীর বাঘা, পাবনার আমিনপুর ও ঈশ্বরদী এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চলে একযোগে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় পাঁচটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ দেশি অস্ত্র, মাদকদ্রব্য ও একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ‘কাকন বাহিনী’ দমনে পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএন সদস্যদের নিয়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’। এতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ টিমের ১ হাজার ২০০ সদস্য অংশ নিচ্ছেন।
ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান আরও জানান, অভিযান চলাকালে পাঁচটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, দেশি অস্ত্র, মাদক ও একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে কাকন বাহিনীর ২১ সদস্যকে।
অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঈশ্বরদী ধানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ স ম আব্দুন নূর। ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রণব কুমার সরকার জানিয়েছেন, অভিযানে চরের বিভিন্ন ঝোপঝাড় ও পরিত্যক্ত ঘাঁটি থেকে দুটি শুটারগান, চাইনিজ কুড়াল, বেশ কিছু দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
জানা গেছে, পাবনার ঈশ্বরদী, সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নাটোরের লালপুর ও রাজশাহীর বাঘা-চারঘাটে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পদ্মা নদীর চর দখল, অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলনকারী হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত রোকনুজ্জামান কাকন ওরফে ‘ইঞ্জিনিয়ার কাকন’। ঈশ্বরদীর পদ্মা নদীতে আধিপত্য বিস্তার করতে সে বারবার গুলি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করায় ঈশ্বরদীতে দফায় দফায় নদীতে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রনে নিতে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া, প্রকাশ্যে গুলি, কথায় কথায় গুলি করে মানুষ হত্যাসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এই কাকন। সে ঈশ্বরদীতেও গড়ে তুলেছে ‘কাকন বাহিনী’।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাকন বাহিনী বিগত কয়েক বছর ধরে চরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, বালু লুট এবং কৃষকদের ফসল লুট করে আসছিল। এই বাহিনীর অপকর্মের প্রতিবাদ করলে কথায় কথায় বন্দুক উঁচিয়ে গুলি চালাতো তারা।
এর আগে গত ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, রাজশাহীর বাঘা ও নাটোরের লালপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিচা ইউনিয়নের চৌদ্দহাজার মৌজার নিচ খানপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় তিন জন নিহত হন। পরে বাহিনীপ্রধান হাসিনুজ্জামান কাকনসহ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় মামলা হয়।
এ ছাড়া রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলায় কাকন বাহিনীর বিরুদ্ধে মোট ছয়টি মামলা রয়েছে।
পদ্মার চরে ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’ অভিযানের আগের দিন শনিবার (৮ নভেম্বর) রাতে কুষ্টিয়া জেলার দৌলুতপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ সোলাইমান জানিয়েছেন, এই মামলায় পদ্মার চরে অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি কাঁকন বাহিনীর সদস্য বলে জানা গেছে।
নিরাপত্তা শঙ্কায় ব্যাহত চরের হাজার বিঘা জমির চাষাবাদ
এদিকে পদ্মার চরে খড় কাটাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলিতে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনায় এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নিচখানপুর এলাকায়। ফের হামলার আতঙ্কে অনেকেই ছেড়েছে ঘর। স্থানীয়দের ভাষ্য, কাঁকন বাহনীর হামলার ভয়ে তাদের প্রতিটা রাত কাটছে। নিরাপত্তা শঙ্কায় ব্যাহত হচ্ছে পদ্মার চরের হাজার বিঘা জমির চাষাবাদ।
বাঘা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার কাছাকাছি হবির চরে বাঘা কৃষি অফিসের আওতাভুক্ত ১ হাজার বিঘা ফসলি জমি রয়েছে। এই চরের জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, বাদামসহ ডাল জাতীয় ফসল ফলে। চরে এসব ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন নিচখানপুরবাসী।
জানা গেছে, গেল ২৭ অক্টোবর দুপুরে এই এলাকার নাজমুল মণ্ডল ও আমান মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতের স্বজনদের দাবি, হত্যার ঘটিয়েছে কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা। পরের দিন ২৮ অক্টোবর লিটন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ মেলে ঘটনাস্থলের অদূরে। তার বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার দৌলুতপুরে। তবে বাঘায় একই গ্রামে পাশাপাশি দুজন হত্যার ঘটনায় দুই পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
নিহত নাজমুল মণ্ডলের স্ত্রী সামেনা বলেন, ‘সেদিন কাজ থেকে এসে বাড়িতে হাতমুখ ধুয়েছে। খাবার খাবে। এ সময় শুনতে পায় চরে আমানকে গুলি করেছে। তখন খাবার না খেয়ে বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর শুনি আমার স্বামীর গুলি লেগেছে। ভালো মানুষ, আহত মানুষকে নিয়ে আসতে গিয়ে গুলি লেগে মারা গেল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে জান্নাতি (৩) জামেলা খাতুন (২)। ছোট মেয়ে দুটি শুধু বাবাকে খোঁজে। কাউকে দেখলে মনে করছে তাদের বাবা। বাবা বাবা বলে চিৎকার করছে সব সময়। কী অপরাধ ছিল আমার স্বামীর, তাকে এইভাবে হত্যা করা হলো? আমি চাই যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে তাদের সরকার ফাঁসি দিক।’
গুলিবিদ্ধ মুনতাজ মণ্ডলের স্ত্রী নার্গিস বেগম (৩০) বলেন, ‘আমার স্বামী নাটোরে ছিল। এলাকায় আসামাত্র শুনেছে ভাগ্নে নাজমুলের গুলি লেগেছে। তখন সে ছুটে যায় তাকে নিয়ে আসতে। সেখানে যাওয়ামাত্র তাকে গুলি করে। তখন স্থানীয়রা তাকে কাঁধে করে নিয়ে আসে। এরপর তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।’
নার্গিস আরও বলেন, ‘ওর (স্বামী) শরীরে প্রায় ১৫০টির মতো গুলি লেগেছে। তার বেশির ভাগ গুলি লেগেছে কোমরের নিচে। প্যান্টের পকেটে তার মোবাইল ফোন ছিল। ফোনে ১০টির বেশি গুলি লেগেছে। গুলিতে জামা-কাপড় ফুটাফাটা হয়ে গেছে। রাজশাহী হাসপাতালে তাকে চার দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপরে তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়।’
নার্গিসের ভাই বলেন, ‘কুষ্টিয়ার হবির চরে (১৪ হাজার নতুন চর) আমাদের আত্মীয়-স্বজনের হাজার হাজার বিঘা জমি রয়েছে। এই জমিতে পেঁয়াজ, গম, খেসারি, মসুর, বুটসহ শীতকালীন বিভিন্ন সবজির চাষ হয়। অনেক জমি চাষ করে ফেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু ২৭ অক্টোবর গোলাগুলির পর থেকে ওই চরে আর কেউ যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একসময় আমরা ওই চরের বাসিন্দা ছিলাম। মোটামুটি অনেককেই আমরা চিনি। তারাও আমাদের অনেককেই চেনে। তাই অনেকেই মিডিয়াতে কথা বলতে চাচ্ছে না। তাদের তো দয়ামায়া নেই। মিডিয়াতে কাঁকন বাহিনীর বিরুদ্ধে বললে তারা চিনে রেখে হামলা করবে বলে। রবিবার (২ নভেম্বর) এলাকার এক গুলিবিদ্ধ ছেলেকে টিকটকে ম্যাসেজ করে হুমকি দিয়েছে। সে মিডিয়াতে কাঁকন বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলেছিল বলে।’
নিহত আমানের স্বজন অঞ্জনা বলেন, ‘আমার সাদাসিদা আমানকে তারা মেরে ফেলেছে। যারা তাকে মেরে ফেলেছে। আমি তাদের ফাঁসি চাই। আমানের কী অপরাধ ছিল।’
পদ্মা নদীর চরে মুদি দোকানের ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘দোকানে তেমন বেচাকেনা নাই। সেদিনের ঘটনার পর থেকে মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেছে। সবার মনে একটাই ভয় যদি তারা আবার হামলা করে।’
রাজশাহীর বাঘা উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, ‘কুষ্টিয়ার কাছাকাছি হবির চরে আমাদের প্রায় ১ হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলে। এই চরে আগে শুধু বাদাম হতো। বর্তমানে সেখানে ধান, গম, ভুট্টা, বাদামসহ ডাল জাতীয় ফসল ফলে। সেখানে কৃষি অফিসের লোক পাঠানো হবে। যাতে কোনও কারণে চাষাবাদ ব্যাহত না হয় সেই চেষ্টা করা হবে।’
বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাম্মী আক্তার বলেন, ‘তারা যদি নিরাপত্তাহীন বোধ করে তাহলে আমাদের জানালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া চরে চাষাবাদের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের সমস্যার বিষয়টি জানা নেই। তবে তারা জানালে কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলবো।’

