হা‌রি‌য়ে যাচ্ছে হাওরের দেশি মাছ
বাংলাদেশ

হা‌রি‌য়ে যাচ্ছে হাওরের দেশি মাছ

দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য ভান্ডার ছিল কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল। বছরের অনেকটা সময় পানিতে ডুবে থাকা এই অঞ্চলের নদী-নালা ও বিল-জলাশয়ে একসময় পাওয়া যেত নানা প্রজাতির সুস্বাদু দেশি মাছ। জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার ধনু নদীর তীরে বালিখলা মাছ বাজারে প্রতিদিন ভোরে শত শত নৌকা ভিড়তো মাছ নিয়ে। এখনও বাজার বসে, মাছ আসে, কিন্তু আগের জৌলুস আর নেই। দেশি মাছ কমে গেছে, ব্যবসাও পড়েছে সংকটে। হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক প্রজাতি। হুমকির মুখে পড়েছে হাজারো জেলের জীবিকা।

ভোরের বাজারে শূন্যতা

রবিবার (৫ অক্টোবর) সকালে বালিখলা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগে যেখানে প্রতিটি কোণে মাছের স্তূপ থাকতো, সেখানে এখন হাতেগোনা কিছু মাছ ঘিরেই সীমিত কেনাবেচা।

ইটনা থেকে আসা জেলে মনির উদ্দিন বলেন, ‘রাতভর জাল ফেলে যা পাই, তা দিয়ে খরচই ওঠে না। পাবদা, চাপিলা-আগে যেসব মাছ হরহামেশা পাওয়া যেত, এখন সেগুলো চোখেই পড়ে না।’

জেলে মতিউর মিয়া বলেন, ‘নৌকা বোঝাই করে মাছ আনতাম একসময়। এখন নৌকার তলায় প‌ড়ে থা‌কে মাছ। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা বদলাচ্ছে-কেউ শহরে পাড়ি দিচ্ছে, কেউ দিনমজুরি করছে।’

কমেছে আড়তের আয়

হাওরে পানি কমে যাওয়ায় মাছের উৎপাদন কমেছে। তার ওপর নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বালিখলা বাজারের প্রবীণ আড়তদার নিপেন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘এ বাজারে ৬৫টি আড়ত আছে। আগে প্রতিটি আড়তে দিনে গড়ে ৬-৭ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হতো। এখন অনেকটাই কমে গেছে। ছোট আড়তদাররা বেশি সংকটে আছে।’

বাজারের সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘দু-তিন বছর আগেও দিনে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হতো। মাছ কমে যাওয়ায় জেলে-আড়তদার সবাই বিপাকে পড়েছে। এখন পাইকাররাও আগের মতো আসে না।’

কেন কমে যাচ্ছে মাছ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরে  আগের মতো বর্ষার পানি থাকে না। পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী ও জলাশয়, যা মাছের চলাচল ও প্রজননে বাধা সৃষ্টি করছে। তার সঙ্গে রয়েছে নিষিদ্ধ জালের নৈরাজ্য। মা-মাছ ও পোনাসহ সব ধরা পড়ে যাচ্ছে নির্বিচারে। এতে মাছের প্রজনন চক্র ভেঙে পড়ছে। হাওরের চাষাবাদেও ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত হচ্ছে। মাছের টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা ও জলাশয় দখলের কারণে মাছের আবাসস্থলও হারিয়ে যাচ্ছে।’

হা‌রি‌য়ে যাচ্ছে হাওরের দেশি মাছ

হারিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্র্য

এক দশক আগেও হাওরে পাওয়া যেত ১৪৩ প্রজাতির দেশি মাছ। বর্তমানে টিকে আছে ৭০ থেকে ৭৫ প্রজাতি। চাপিলা, শিং, গজার, খলসে, কালবাউশ, টাটকিনি, মহাশোল, শোলসহ অনেক মাছ আর তেমন চোখে পড়ে না। কিছুটা পাওয়া যায় রুই, কাতল, বোয়াল, টেংরা, গজার। তবে সেগুলোও আগের মতো সহজলভ্য নয়।

সংখ্যার হিসাবেও শঙ্কা

২০২২-২৩ অর্থবছরে কিশোরগঞ্জ জেলায় মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে হাওর থেকে এসেছে ২৮ হাজার ২০ টন, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ জেলার বার্ষিক মাছের চাহিদা ৭০ হাজার ৫৩০ টন।

উৎপাদনের সংখ্যাটি এখনও সন্তোষজনক মনে হলেও হাওরভিত্তিক মাছের সরবরাহ প্রতিবছর কমছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে চাহিদা পূরণে হাওরের ওপর নির্ভর করা কঠিন হয়ে পড়বে-এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

মাছ শুধু খাবার নয়, হাওরের প্রাণ

জেলে হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার দাদা, বাবা মাছ ধরে সংসার চালাতেন। এখন মনে হয় এই পেশা আমাদের আর টানবে না। ছেলে শহরে কাজ খুঁজছে।’

সচেতন মহলের মতে, মাছ শুধু খাবার নয়, এটি হাওরবাসীর অন্যতম জীবিকা ও অস্তিত্বের অংশ।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পানি কমে যাওয়া ও নিষিদ্ধ জালের কারণে মাছের প্রজনন চক্র ভেঙে পড়ছে। প্রজাতি রক্ষায় আমরা অভিযান চালাচ্ছি, জাল জব্দ করছি। চলছে আরও নানা কর্মকাণ্ড। তবে শুধু প্রশাসনের পক্ষে এটা সম্ভব নয়, স্থানীয়দেরও সচেতন হতে হবে।’

Source link

Related posts

দূষণ কমাতে বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক

News Desk

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুন, পুড়েছে শতাধিক ঘর

News Desk

বাবুল ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ইলিয়াসের বিরুদ্ধে আরও এক মামলা

News Desk

Leave a Comment