ঢাকঢোল আর সুরের মূর্ছনা ছাড়া যেন পূর্ণতা পায় না দুর্গাপূজা। প্রতিটি পর্বে থাকা চাই ঢাকের বাজনা ও সুরের আবহ। এরই মধ্যে সর্বত্র পৌঁছে গেছে আনন্দময়ী দুর্গার আগমনবার্তা। মণ্ডপ সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পূজারিরা। পূজার আনুষ্ঠানিকতার প্রধান অনুষঙ্গ ঢাকের চাহিদা মেটাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রতি বছরের মতো এবারও বসেছে ‘ঢাকের হাট’। ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী এই হাটে ঢাক বাজানোর মুন্সিয়ানা দেখে ঢাকিদলকে ভাড়া করে নিয়ে যান পূজার আয়োজকরা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে শুরু হয়েছে হাটের কার্যক্রম। চলবে রবিবার মহাষষ্ঠীর গভীর রাত পর্যন্ত। এবারের হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দুই শতাধিক ঢাকিদল (বাদকদল) হাজির হয়েছেন।
বিকালে হাটে গিয়ে দেখা যায়, বাদ্যযন্ত্রের বাজনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে কটিয়াদীর পুরানবাজার। ঢাকঢোল আর বাঁশি বাজিয়ে পূজার আয়োজকদের নজর কাড়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। বাজনা ও সুরের তালে তালে চলছে প্রতিযোগিতা; কে বাজাবেন সেরাটা। কার সুরে মুগ্ধ হবেন পূজার আয়োজকরা। ঢাকিদল নিজেদের সুর আর দক্ষতা উজাড় করে দিচ্ছেন মণ্ডপে বাজানোর সুযোগ পেতে। অনেকে আবার বায়নার জন্য দরদাম করছেন। পূজার আয়োজকরা ঘুরে ঘুরে দেখছেন, সুর ও বাজনা শুনছেন। কেউ কেউ পছন্দ করছেন, কেউ আবার করছেন দরদামও। শেষে যার বাজনায় মন গলেছে, তার সঙ্গেই করছেন চুক্তি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার হাটে এসেছে প্রায় দুই শতাধিক ঢাকিদল। এসব দলে সদস্যের সংখ্যা অন্তত এক হাজার। তবে নানা কারণে আগের জৌলুশ হারাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী হাটটি। কমেছে ঢাকিদলের চাহিদাও।
ঢাকিদল ভাড়া করতে নরসিংদীর ঘোড়াশাল থেকে বিকালে ঢাকের হাটে এসেছেন সেখানকার পূজার আয়োজক কাজল চন্দ্র ভৌমিক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই হাটের কথা দীর্ঘদিন শুনছিলাম। এবার প্রথম এলাম। একজন ঢাকিকে মনে ধরেছে। সে বাজায় ভালো। ১৮ হাজার টাকায় তার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।’
কিশোরগঞ্জ সদরের অনুকূল দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের মণ্ডপে বাজনার জন্য পাঁচ সদস্যের ঢাকিদলকে ৯০ হাজার টাকায় ভাড়া করেছি। তবে এবার ঢাকিদল কিছুটা কম এসেছে। সেজন্য চাহিদা বেশি থাকায় টাকা একটু বেশি লাগছে। আগের সেই জৌলুশ নেই। এজন্য ঢাকিদল দিন দিন এখানে কম আসছে।’
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকিদল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন ও পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তী সময়ে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে। এখনও হাট বসে সেখানে।
স্থানীয় লোকজন জানান, বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী থেকে হাটে ঢাকের দল আসে বেশি। তাদের সঙ্গে ঢাকঢোল ছাড়াও রয়েছে বাঁশি, সানাই, করতাল, খঞ্জনি, মন্দিরা, ঝনঝনিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। শুরুর রীতি অনুযায়ী, এখনও হাটে ঢাকিরা পূজারির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সমবেতভাবে বাজনা বাজান। বাজনায় যে দলের যত মুন্সিয়ানা, পূজারির কাছে তাদের কদর তত বেশি। তবে নাম ঢাকের হাট হলেও এখানে বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচা হয় না। এখানে যারা আসেন সবাই বাদ্যযন্ত্র বাজান। তাদের বাজনা শুনে, দক্ষতা দেখে আয়োজকরা মণ্ডপে বাজানোর জন্য ভাড়া করে নেন। সম্মানী নির্ধারিত হয় দল বা সদস্য সংখ্যা কিংবা বাদ্যযন্ত্র আর দক্ষতার ওপর।
হাটে আসা বিক্রমপুরের ঢাকি পরিমল দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার ফোনে অনেকে যোগাযোগ করেছিল, যাইনি। এখানে না আসলে মন মানে না। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। এই আনন্দটা আলাদা। আমি ২০ হাজার টাকা চেয়েছি। দর কষাকষি চলছে, কমবেশি করে চলে যাবো যেকোনো মণ্ডপে।’
আরেক ঢাকিদলের সদস্য সুমন মণিঋষি বলেন, ‘আমার বাদকদল নিয়ে গত ২০ বছর ধরে এই হাটে আসি। এবার দেড় লাখ টাকা চেয়েছি আমরা। এক লাখ ২০ হাজার টাকা পেলে বাজাতে যাবো।’
ঢাকের হাট কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরই যুক্ত করেনি বরং ঢাকিদলকে দেখতে ভিড় করেছেন অন্য ধর্মের লোকজনও। তাদের কাছে এই হাট শুধু বাদ্যযন্ত্রের আয়োজন নয়, এটি ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অংশ।
ঢাকের হাটের সমম্বয়ক শীতল চন্দ্র সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শ্রী মা সংঘ হাটের তত্ত্বাবধান করছে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় ঢাকের হাট। রাজপ্রাসাদে পূজার জন্য সেরা ঢাকির সন্ধানে বার্তা পাঠানো হয়েছিল বিক্রমপুরে। সেখান থেকে বহু ঢাকি নৌপথে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা তাদের বাজনা শুনে সেরা দল বেছে নেন। সেই থেকেই শুরু হয় এই ঐতিহ্যের যাত্রা। হাটে আসা বাদকদের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করেছি আমরা।’