প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে রেকর্ড গড়েছে কুমিল্লা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও ৯০২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। রফতানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয় অর্থনীতিতে এ ইপিজেডের গুরুত্ব বাড়ছে।
কুমিল্লার দক্ষিণ চর্থা এলাকায় ২০০০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইপিজেড সূত্রে জানা গেছে, এখানে কর্মরত ৫০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত তিন অর্থবছরে পণ্য রফতানি করেছে দুই হাজার ৯৩৩ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন ডলারের। তবে ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত রফতানি না বেড়ে কমে গিয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮১৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৯০ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১১ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯০২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিভিন্ন দেশে যায়। হিসেবে আগের বছরগুলোর চেয়ে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রফতানি বেড়েছে।
যে কারণে বেড়েছে রফতানি
গত অর্থবছরে রফতানি বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কুমিল্লা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহকারী পরিচালক এএইচএম এরশাদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনাকালীন অনেক অর্ডার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন কেউ কারও দিকে তাকায়নি। একটা খারাপ অবস্থা ছিল। অন্যদিকে যুদ্ধরত দেশ আমদানি-রফতানি ছেড়ে সামরিক দিকে নজর দেয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্গে অনেক দেশ ব্যবসায় যুক্ত। যে কারণে শুধু কুমিল্লা ইপিজেডে নয়, সব দেশকে বিপাকে পড়তে হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় পণ্য রফতানি বেড়ে যায়। বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা অর্ডার বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে রফতানি বেড়েছে।’
একই কথা বলেছেন ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কুমিল্লা ইপিজেডে প্রতিনিয়ত কোটি ডলারের পণ্য রফতানির বিষয় থাকে। এতে একজন রফতানিকারক ভাগ্য বদলে ফেলতে পারেন। আবার কোনও একটি দুর্ঘটনা যেকোনো পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে। যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যা এখনও চলছে। তবে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আমাদের রফতানি বেড়েছে। তবে রফতানির খাত বাড়েনি। আগে যারা পণ্য নিতেন এখনও তারাই নিচ্ছেন, তবে পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
যেসব পণ্য উৎপাদন হয় এবং যেসব দেশে যায়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫ শতাংশ পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সুইডেন, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তবে রফতানি বেশি হয় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে।
বিনিয়োগে শীর্ষে আছে অন্তত ১৫টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিনিয়োগ আছে ইপিজেডে।
উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে, গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ, সোয়েটার, ফেব্রিক্স, টেক্সটাইল ডাইজ অ্যান্ড অক্সিলিয়ারিজ, ইলেকট্রনিকস পার্টস, এলিমেনেটিং ব্রাশ, ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার অ্যাপারেলস, ক্যামেরা কেস, ব্যাগ, ইয়ার্ন, প্লাস্টিক পণ্য, হেয়ার ও ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ, মেডিসিন বাক্স, আই প্যাচ, কার্পেট, গ্লাভস, লাগেজ, মেডেল, পেপার প্রোডাক্ট ইত্যাদি।
এখানে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় পণ্য যেমন- হেয়ার এক্সেসরিজ ও বিউটি গুডস, লেদার ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার এক্সেসরিজ, কিচেন প্রোডাক্টস, মেডেল ও ট্রফি, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, কেমিক্যাল, টেন্টস অ্যান্ড স্লিপিং প্রোডাক্টস ইত্যাদি উৎপাদন ও রফতানি হয়।
উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৪৬ প্রতিষ্ঠান
ইপিজেজের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে এখানে ৫২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৪৬টি। ছয়টি উৎপাদনের অপেক্ষায় আছে। বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টি বিদেশি, আটটি দেশি-বিদেশি যৌথ-উদ্যোগে এবং ১৩টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত প্রায় ৬১৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছে।
রফতানিতে এগিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান
ইপিজেডে তিন ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ক্যাটাগরিতে অর্থাৎ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৩১টি, বি ক্যাটাগরির অর্থাৎ যৌথ মালিকানাধীন আটটি প্রতিষ্ঠান। সি ক্যাটাগরির বা দেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ১৩টি। এর মধ্যে রফতানির শীর্ষে রয়েছে পাঁচ প্রতিষ্ঠান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এ ক্যাটাগরির মেসার্স কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড। চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে ব্যবসা শুরু করেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি ৯১ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য রফতানি করেছে। বাকি চার প্রতিষ্ঠান হলো- সুরতি টেক্সটাইল (বিডি) লিমিটেড, নাসা তেইপ ডেনিমস লিমিটেড, জিংস্যাং সুজ (বিডি) লিমিটেড ও ইস্টপোর্ট লিমিটেড।
নতুন বিনিয়োগকারী থাকলেও প্লট পাচ্ছেন না
নতুন বিনিয়োগকারী থাকলেও ইপিজেডের সব প্লট ইতিমধ্যে বরাদ্দ হয়ে গেছে। যে কারণে নতুন বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও প্লট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী আসেন এবং অনুরোধ করেন প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। কিন্তু পর্যাপ্ত প্লট না থাকায় বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। যদি সরকার প্লট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে সেটি সম্ভব।
ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, ‘ইপিজেড আরও সমৃদ্ধির অপেক্ষায় আছে। এটি দেশের মাঝামাঝি ও বন্দর নগরী থেকে কাছে হওয়ায় এর গুরুত্ব অন্যদের থেকে আলাদা। যে কারণে এখানে বিনিয়োগকারীদের নজর বেশি। কিন্তু প্লট খালি না থাকায় আমরা সুযোগ দিতে পারছি না।’
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরা
ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই নারী। যা এ অঞ্চলের নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। অনেকে এখানে কাজ করে ভাগ্য বদলেছেন। যার একটি বড় অংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
তাদের একজন নাঙ্গলকোট উপজেলার মাহীনি এলাকার মনোয়ারা বেগম। দুই সন্তান রেখে স্বামী চলে যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেছেন। এখানের আয় দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন তিনি।
মনোয়ারার বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কীভাবে সংসার চালাবো, ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর পাশের এলাকার এক নারী কর্মী আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। এখন ভালোই চলছে সব।’
স্থানীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা
প্রতি মাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ ছাড়া ইপিজেডে কর্মরত প্রায় ২৭০ জন বিদেশি কর্মী শহরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন। যারা ইপিজেড সংলগ্ন এলাকায় থাকেন। এতে বদলে গেছে চর্থা এলাকার চিত্র। প্রতিষ্ঠান ঘিরে তৈরি হয়েছে কয়েকশ প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে নতুন বাজার। কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের। বেড়েছে বাসা ভাড়া। চর্থা যেন এক নতুন নগরী।
ইপিজেড সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, শ্রমিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইপিজেডের যেকোনো বিনিয়োগকারী মোট আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভাড়া ও ইউটিলিটি চার্জ, প্রতিষ্ঠানের কর্মরত বিদেশিদের যাবতীয় খরচ এবং অন্যান্য পরিচালনাগত কাজে ব্যয় করে। যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি সার্কুলার অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ইপিজেড ঘিরে আবাসন, পরিবহন, রেস্টুরেন্ট, নির্মাণ শিল্প ও প্রতিষ্ঠানসহ ইপিজেডে সরবরাহের লক্ষ্যে বেকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে। বলা যায়, এখানের বাসিন্দাদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইপিজেড।
এই এলাকার ইয়াছিন মাকের্টের স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা সদর উপজেলার বাসিন্দা ইব্রাহীম খলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে প্রবাসে ছিলাম। তেমন কিছু করতে পারিনি। পরে বাড়ি চলে আসি। পরে এখানে দোকান বসাই। প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকেন ফ্রাই, চাপ, মাসালাসহ নানা খাবার বিক্রি করি। মাসে ৪০-৪৫ হাজার টাকা আয় থাকে। দোকানে আরও দুজন সহযোগী আছেন। তাদেরও সংসার চলে।’