সেই স্বপ্ননগরের ২৫০ পরিবার পানিবন্দি, না খেয়ে কাটছে দিন
বাংলাদেশ

সেই স্বপ্ননগরের ২৫০ পরিবার পানিবন্দি, না খেয়ে কাটছে দিন

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ও ধারাবাহিক বৃষ্টিপাতে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় মধুমতি নদীর পানি বৃদ্ধিতে ‘স্বপ্ননগর আশ্রয়ণ প্রকল্প’ এলাকায় বসবাসরত কমপক্ষে ২৫০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত একসপ্তাহ ধরে ওই এলাকার অধিকাংশ ঘর পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ঘর ছেড়ে কেউ রাস্তায় কেউ বা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে বয়স্ক মানুষ ও গৃহপালিত পশু। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলছেন, পানিবন্দি মানুষের মাঝে দ্রুতই খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করবো।

২০২০-২১ অর্থ বছরে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৩ একর জমির ওপর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের চরকাতলাসুর গ্রামে নির্মাণ করা হয় টিনশেড ওয়াল বিশিষ্ট ২৫০টি ঘর। এলাকাটিকে জেলা প্রশাসন ওই সময় ‘স্বপ্ননগর’ আবাসন নামকরণ করা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আলফাডাঙ্গা উপজেলার চরকাতলাসুর এলাকায় ‘স্বপ্ননগর’ আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রবেশপথে কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও তার চেয়েও বেশি। সারি সারি ঘরগুলোর প্রতিটি গলিতেও পানি প্রায় হাঁটু সমান। বেশির ভাগ ঘরের মেঝেতে ঢুকে পড়েছে নোংরা পানি। পানিতে তলিয়ে গেছে রান্না করার চুলা। এ ছাড়া পানিতে তলিয়ে গেছে টয়লেটের রিং-স্লাব। এতে নোংরা পানির দুর্গন্ধে অসহনীয় হয়ে পড়েছে পরিবেশ। ছোট শিশুরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না। সুপেয় পানির অভাব ও নোংরা-দুর্গন্ধযুক্ত পানির স্পর্শে বেড়েছে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে সাপের উপদ্রব। 

সেখানে বসবাসরতরা দিন এনে দিন খায়। পশু পালন, ভ্যান চালানো, কৃষি কাজ, টেইলার্সের কাজসহ নানান পেশায় জড়িত তারা। পানিবন্দি হওয়ায় দিন এনে দিন খাওয়া বাসিন্দারা বেকার হয়ে পড়েছে। স্বপ্ননগরের বাসিন্দাদের ঘুম নেই, খাবার নেই, এর মধ্যে আবার সাপের প্রকোপ। প্লাবিত হওয়া ঘরগুলোতে বসবাসকারীদের ঘরে জ্বলছে না তিনবেলা চুলা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩৪ নম্বর ঘরের বাসিন্দা জবেদা বেগম বলেন, ‘মধুমতি নদীতে সাতবার বাড়ি ভাঙছে। পরে সরকার এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকার জন্য একটা ঘর দিয়েছে। কিন্তু এখানে এসেও চরম বিপাকে পড়েছি। ঘরের মধ্যে পানি। রান্না ঘর তলিয়ে গেছে। ঠিকমতো রান্নাবান্না করতে পারছি না। রয়েছে আবার অর্থ সংকট। তিনবেলার রান্না করার জায়গায় এক বেলা করে কোনোরকম বেঁচে থাকা লাগছে।’

স্বপ্ননগরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) বলেন, ‘পানি হওয়াতে সব জায়গায় তলায় গেছে। ক্ষেত খামারি যা করছিলাম সব পানির নিচে। দিন না খেয়েও যাচ্ছে, তিনবেলার জায়গায় এক বেলা খাচ্ছি, এখন ঘরে খাটের ওপর বসে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নাই। তবে এর ভেতর কেউ খোঁজখবর সরকারিভাবে কেউ নিচ্ছে না।’

সেই স্বপ্ননগরের ২৫০ পরিবার পানিবন্দি, না খেয়ে কাটছে দিন

ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে হয় উল্লেখ করে সেলিনা বেগম নামে এক নারী বলেন, ‘কয়েক দিন আগে একটি সাপ দেখতে পেয়ে ভয়ে সবাই আতঙ্কিত হয়ে যায়। সাপ, পোকামাকড়ের ভয়ে রাতে না ঘুমিয়েও চৌকির ওপর বসে থাকতে হয়।’

দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে আশ্রয়ণ প্রকল্পের শিক্ষার্থী মীম খানম ও ফাতেমা খানম। তারা দুই জন স্থানীয় চর কাতলাসুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তারা বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে স্কুলে যাই। কোনও সময় পানি দিয়ে যাওয়া আসার সময় পড়ে গিয়ে জামা-কাপড় ও বইখাতা ভিজে যায়।’ 
শিখা বেগম নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার মেয়েডা সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পানি বাড়ার কারণে পড়ালেখায় সমস্যা হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ প্রাইভেট পড়তে যেতে পারছে না।’

চর কাতলাসুর গ্রামের বাসিন্দা ও আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার মুদি দোকানি ফিরোজ মোল্লা বলেন, ‘গত ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই এলাকায় এত বন্যা হয়নি। আমার নিজের ঘরে খাটের ওপরও পানি। বউ বাচ্চাদের বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। দোকানে তেমন বেচাকেনা নাই। আমার দোকানেও পানি উঠছে উঠছে ভাব।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য বিল্লাল মোল্লা বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা বসবাস করেন তারা খুব দরিদ্র মানুষ। তারা দিন আনে দিন খায়। তারা সকালে কাজে বের হয়, আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। সারাদিন তারা বাইরে থাকেন। কিন্তু এখন তারা ঠিকমতো কাজকর্ম যেতে পারছে না।’

সেই স্বপ্ননগরের ২৫০ পরিবার পানিবন্দি, না খেয়ে কাটছে দিন

এ বিষয়ে গোপালপুর ইউপি চেয়ারম্যান খান সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দ্রুতই তালিকাটি শেষ করে উপজেলার সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেওয়া হবে। তবে সেখানে বসবাসকারীদের খোঁজ খবর রাখছি।’

আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেল ইকবাল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বপ্ননগর আশ্রয়ণ প্রকল্পে জলাবদ্ধতার খবর পেয়েছি। মধুমতি নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে সেখানে হাঁটু সমান পানি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভুক্তভোগীদের তালিকা করছেন। স্বপ্ননগরের বাসিন্দা ও মধুমতি নদীর ভাঙনে কবলে পড়া বাসিন্দাদের জন্য ৪ মেট্রিক চাল ও নগদ দুই লাখ টাকা সরকারি অনুদান পাওয়া গেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ইনশা আল্লাহ আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে চাল ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে সংশ্লিষ্ট এলাকায়।’

Source link

Related posts

দিনের আলোতেই দখল হচ্ছে ‌‘মরাপদ্মা’!  

News Desk

গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে

News Desk

বাতাসে খুলে পড়লো ৭০ কোটি টাকার ভবনের গ্লাস

News Desk

Leave a Comment